বগুড়ায় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে মারা যাওয়া আইনজীবীর সহকারী হাবিবুর রহমানের (৩৬) লাশ নিয়ে লুকোচুরির অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। স্বজনদের অভিযোগ, নির্যাতন করে পরিকল্পিতভাবে হাবিবুরকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে রাত থেকে লাশ নিয়ে লুকোচুরি করেছে পুলিশ। শরীরে আঘাতের চিহ্ন আছে কি না, নিশ্চিত হতে ময়নাতদন্তের আগে স্বজনেরা লাশ দেখতে চাইলেও পুলিশ অনুমতি দেয়নি। তবে পুলিশ বলছে, স্বজনদের অভিযোগ ভিত্তিহীন।
এর আগে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বগুড়া আদালতের ফটক থেকে ওই আইনজীবীর সহকারীকে ডিবি কার্যালয়ে তুলে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ ওঠে। অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পর তিনি মারা যান বলে পুলিশ জানিয়েছে। বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
হাবিবুর রহমান বগুড়া আদালতের আইনজীবী সহকারী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি বগুড়া আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মঞ্জুরুল ইসলাম ওরফে মঞ্জুর সহকারী ও সম্পর্কে ভাগনে। হাবিবুর বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার জোড়া দামোরপাড়া গ্রামের আবদুল কুদ্দুসের ছেলে।
আবদুল কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতে ডিবি হেফাজতে হাবিবুর মারা যান। খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে গেলেও পুলিশ লাশ দেখতে না দিয়ে তড়িঘড়ি করে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে তালা লাগিয়ে দেয়। লাশ দেখতে রাতভর দফায় দফায় আকুতি জানালেও পুলিশ সায় দেয়নি। তিনি বলেন, হাবিবুর সুস্থ ছিলেন। তাঁর কোনো হৃদ্রোগ ছিল না। গতকাল আদালতে স্বাভাবিকভাবে কাজ করেছেন। বাড়ি ফেরার সময় আদালতের ফটক থেকে তাঁকে তুলে নেয় ডিবি। এরপর কার্যালয়ে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যার পর ঘটনা ধামাচাপা দিতে হাসপাতালে ভর্তি করে। এটা কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। দাফনের পর হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে মামলা করবেন তিনি।
হাবিবুরের খালা ফজিলাতুন্নেছা ফৌজিয়া অভিযোগ করে বলেন, সকালে ময়নাতদন্তের কাটাছেঁড়ার আগে ছেলেকে একনজর দেখতে বহুবার পুলিশের কাছে আকুতি জানিয়েছেন তাঁর বাবা। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ময়নাতদন্তের আগে লাশ দেখানো হবে বলে আশ্বস্ত করেন। বেলা সাড়ে ১১টায় মর্গ থেকে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নেওয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্সে তোলার আগে বাবা লাশ দেখতে চাইলে পুলিশ স্বজনদের লাশকাটা ঘরের সামনে যেতে বলে। কিন্তু স্বজনেরা সেখানে পৌঁছানোর আগেই পুলিশ অ্যাম্বুলেন্স থেকে লাশ নামিয়ে ভেতরে নেয়। ময়নাতদন্তের পর সাড়ে ১২টার দিকে লাশ হস্তান্তর করে।
তবে ময়নাতদন্তের সময় দায়িত্বরত এসআই রাসেল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সেখানে স্বজনেরাও উপস্থিত ছিলেন। মর্গ থেকে লাশ অ্যাম্বুলেন্সে স্বজনেরাই তুলেছেন। লাশকাটা ঘরে ঢোকানোর পরপরই ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক ময়নাতদন্তের কাজ শুরু করেন। এ জন্য পরিবারকে লাশ দেখানো সম্ভব হয়নি।
বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মিজানুর রহমান বলেন, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে হৃদ্রোগে মৃত্যুর দাবি করায় হৃদ্যন্ত্র কেটে সংরক্ষণ করা হয়েছে। শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল কি না, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে।
বগুড়া আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মঞ্জুরুল হকের সহকারী ছিলেন হাবিবুর। তিনি বলেন, হাবিবুরের বিরুদ্ধে কোনো পরোয়ানা নেই। গতকাল সন্ধ্যায় আদালত ফটক থেকে তুলে নেওয়ার পর বিনা দোষে নির্যাতন চালিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়।
তবে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে বগুড়া ডিবির পরিদর্শক মোস্তাফিজ হাসান বলেন, মাস দুয়েক আগে শাজাহানপুর থানায় খুকি বেগম (৬০) নামের এক বৃদ্ধা খুন হন। ওই মামলার ছায়া তদন্ত করার সময় একজন বৃদ্ধাকে আটক করে ডিবি। ওই বৃদ্ধার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাবিবুরকে আটক করা হয়। ডিবি কার্যালয়ে নেওয়ার পর আটক বৃদ্ধাকে দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েন হাবিবুর। হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
দুপুরে হাবিবুরের লাশ শাজাহানপুরের জোড়া দামোরপাড়া গ্রামে নিজ বাড়িতে নেওয়ার পর স্বজনদের কান্নায় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। হাবিবুরের স্কুলশিক্ষক স্ত্রী সোহেলী পারভীন আহাজারি করতে করতে বারবার স্বামীর শোকে মূর্ছা যাচ্ছিলেন। বাবার লাশের সামনে কাঁদছিল দুই সন্তান নাঈম (১৪) ও নাবিল (৫)।
সোহেলী বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘বিএনপিকে সমর্থন করাই কাল হলো হাবিবুরের। রাজনীতির কারণে ১০ বছর আগে একটি মামলায় পুরো পরিবারকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এবার নতুন করে মিথ্যা অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদের নামে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে। কার কাছে বিচার চাইব? পুলিশ নিজেরাই জ্যান্ত একটা মানুষকে তুলে নিয়ে মেরে ফেলল।’
হাবিবুর বগুড়া আইনজীবী সহকারী সমিতির নেতৃত্বের পাশাপাশি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে দাবি করেছেন স্বজনেরা। হাবিবুরের বাবা আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘আমার গোটা পরিবার বিএনপির সমর্থক। হাবিবুর দলীয় কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন। এ কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ইন্ধনে ডিবি পুলিশ বিনা দোষে হাবিবুরকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে গাড়িতে তুলে নেয়। আওয়ামী লীগের ইন্ধনেই পুলিশের হেফাজতে হাবিবুরকে হত্যা করা হয়েছে।’
এক দশক আগে হত্যা মামলার আসামি ছিলেন হাবিবুর
পুলিশ জানায়, ২০১৩ সালে শাজাহানপুরের জোড়া দামোরপাড়া গ্রামে বিপ্লব প্রামাণিক (১৫) নামের এক কিশোরকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। বগুড়া সদরের কৈচড় এলাকার রেললাইন থেকে তার লাশ উদ্ধার হয়। ওই ঘটনায় বিপ্লবের বড় ভাই বাদী হয়ে শাজাহানপুর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
ওই মামলার প্রধান আসামি ছিলেন হাবিবুর। হাবিবুরের বাবাকেও আসামি করা হয়। ২০১৩ সালের ৩১ আগস্ট তদন্ত শেষে হাবিবুরসহ সাতজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। বর্তমানে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন ও সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে আছে।
শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম বলেন, বিপ্লব প্রামাণিক হত্যা মামলার সাক্ষী ছিলেন তাঁর সৎমা খুকি বেগম (৬০)। গত ২ আগস্ট খুকি নিখোঁজ হন। দুদিন পর তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় খুকির ছেলে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। মামলার ছায়া তদন্ত করছিল ডিবি। মঙ্গলবার ওই লাশের একটা পায়ের খণ্ডাংশ উদ্ধার করার পাশাপাশি মনোয়ারা বেগম নামের এক বৃদ্ধাকে আটক করা হয়। মনোয়ারা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডে হাবিবুরের জড়িত থাকার তথ্য দেন। হাবিবুরকে মনোয়ারা বেগমের মুখোমুখি করতে গতকাল আদালতের সামনে থেকে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) স্নিগ্ধ আখতার বলেন, ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে আসার পরপরই হাবিবুর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবুও নির্যাতনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বিষয়টি তদন্ত করা হবে।