কাদামাটিতে জীবন খোঁজেন বখতিয়ার
নানা কারণে মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই এ পেশা থেকে সরে গেছেন। শিল্পকে ভালোবেসে খোকন কারিগর চলছেন স্রোতের বিপরীতে।
লম্বা আকৃতির একটি ঘরে এলোমেলোভাবে রাখা হয়েছে মাটি দিয়ে বানানো টিস্যু বক্স, ডেকোরেটিভ ইনডোর প্ল্যান্ট হোল্ডার, বিমূর্ত (অ্যাবস্ট্র্যাক্ট) পটারি, শ্যাডো ল্যাম্প, ঘরের সাজসজ্জায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ছোট আকৃতির টেরাকোটাসহ মাটির বিভিন্ন শিল্পকর্ম। বখতিয়ার রহমান খান ওরফে খোকনের কারখানা এটি।
মৃৎশিল্পী বখতিয়ারের কাছে এটি স্টুডিও। এখানেই চলে তাঁর জীবনযাপন ও সংস্কৃতিচর্চা। দুই যুগের বেশি সময় ধরে তিনি এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এ সময়ের মধ্যে পরিবার ও স্থানীয় লোকজনের কাছে তাঁর নামও পাল্টে গিয়ে হয়েছে ‘খোকন কারিগর’। স্ত্রী ডাকেন ‘কারিগর’ নামে।
প্লাস্টিকের আধিপত্য, কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়াসহ নানা কারণে মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই এ পেশা থেকে সরে গেছেন। বন্ধুমহলে মেধাবী হিসেবে পরিচিত খোকন কারিগরের ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টোটা। নানা সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতায় একসময় কিছু সময়ের জন্য মৃৎশিল্পের এ কার্যক্রম থেকে নিজেকে একবার সরিয়ে নিলেও আবার ফিরে আসেন। এরপর থেকে মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
সম্প্রতি ঢাকার সাভারের কাতলাপুরে বখতিয়ার কারিগরের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তাঁর বাসভবনের একটি অংশে পাকা দেয়ালের টিনের চালার একটি লম্বা কক্ষের কিছু অংশ দখল করে মেঝেতেই রাখা হয়েছে মাটির তৈরি বিভিন্ন পণ্য। কক্ষের শেষ অংশে বানানো হয়েছে কাঁচা মাটির তৈরি পণ্যগুলোকে পোড়ানোর জন্য চুল্লি। একটি অংশে সাজানো-গোছানো অবস্থায় কাঠের কাজ করতে কাঠ কাটার যন্ত্রপাতি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ছোট আকৃতির কাঠের তাকে রাখা হয়েছে শিল্পের ছোঁয়া লাগা কাঠ ও মাটির মিশ্রণে তৈরি কিছু শিল্পকর্ম। এ সময় বখতিয়ারকে দেখা যায়, মাটি দিয়ে হুইলে পটারি বানাতে।
যেখান থেকে শুরু
১৯৯৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চিন্তা বাদ দিয়ে বখতিয়ারের ইচ্ছা হয় কবি হওয়ার। মির্জা গালিবের চরিত্র ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল তাঁকে। লক্ষ্যহীন জীবনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। এসব কারণে আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোনো চেষ্টা করেননি। একপর্যায়ে একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরিচয় হয় ওই স্কুলের ড্রইং শিক্ষক হীরার সঙ্গে। ওই সময় বনসাই করার চেষ্টা করতেন বখতিয়ার। কথা প্রসঙ্গে ওই শিক্ষক জানিয়েছিলেন, মাটি এনে দিলে বনসাইয়ের জন্য তাঁকে টব বানিয়ে দেবেন। এ সময় কাজটি নিজেই শিখে নেন বখতিয়ার। পরে শিক্ষক হীরা, বন্ধু রোকন ও বাবুকে নিয়ে তিনি ৩০০ টাকার মাটি কিনে টব বানানোর কাজ শুরু করেন।
প্রথম দিকে বাঁশের বেড়ার একটি ঘরে কলমদানি, টব, ছোট ছোট টেরাকোটা বানানো শুরু করেন বখতিয়ার ও তাঁর সঙ্গীরা। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক স্বপন শিকদারের সঙ্গে পরিচয় হয় বখতিয়ারের। স্বপন শিকদার মাটি দিয়ে বানানো পণ্য পোড়ানোর বিষয়টি হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছিলেন বখতিয়ারকে।
বখতিয়ারের একা পথচলা
বছরখানেক পর উন্নত জীবনের লক্ষ্যে হীরা ও দুই বন্ধু চলে যান। ২০০৪ সাল থেকে একাই কাজ করতে থাকেন বখতিয়ার। এর মধ্যে তিনি সাভার কলেজ থেকে স্নাতক (ডিগ্রি) পাস করেন। ছেলে মাটির কাজ করায় অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী বখতিয়ারের বাবাকে নেতিবাচক মন্তব্য শুনতে হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন বলতেন, ছেলে ডিগ্রি পাস করে মাটির কাজ করে, ‘পুতলা’ বানায়। বাবার অবসরের কারণে পরিবারের দায়িত্ব নিতে তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি নেন বখতিয়ার। কিন্তু পরিবেশের সঙ্গে মানাতে না পেরে তিন মাস কাজ করে চাকরি ছেড়ে ফিরে এসে বাঁশের বেড়ার ঘরের তালা খোলেন।
এবার মৃৎশিল্পের জগতে অন্যতম পথিকৃৎ মরণ চাঁদ পালের সঙ্গে পরিচয় হয় বখতিয়ারের। মরণ চাঁদের কাছ থেকে রং করার ‘কষ’ বানানো শেখেন। দীর্ঘ ৯ বছরেও আর্থিকভাবে তেমন সচ্ছলতা না আসায় বখতিয়ারকে পরিবারের সদস্যরা এ কাজ ছেড়ে দিতে বলেন।
হতাশা থেকে একদিন মরণ চাঁদের কাছে বিষয়টি খুলে বলার পর তিনি বখতিয়ারকে বলেছিলেন, ‘তুমি তোমার পথে থাকো, কাজ করতে থাকো।’ কথাটি ভীষণভাবে উজ্জীবিত করেছিল বখতিয়ারকে। এরপর ধীরে ধীরে মাটির সঙ্গে কাঠের মিশ্রণ ঘটিয়ে বানাতে থাকেন নানা পণ্য।
বখতিয়ারের বাড়ির অদূরে একসময় মাটির কাজ করত কয়েকটি পরিবার। গত ২০ বছরে সে পরিবারগুলো মাটির কাজ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে অন্য পেশায় জড়িয়েছেন। মৃৎশিল্পের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় বখতিয়ার কারিগর স্বপ্ন দেখেন এ-সংক্রান্ত একটি ইনস্টিটিউট করার।
বখতিয়ার কারিগর যা বলেন
মাটি দিয়ে তৈরি পণ্যেই সংসার চলে বখতিয়ারেরর। তিনি জানান, বাজার এখন প্লাস্টিকের দখলে। এখন শুধু শিল্পমনা ও শৌখিন মানুষ মাটির পণ্য ব্যবহার করেন। তাঁর দৃষ্টিতে এ খাতের প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও পণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া। এসব কারণে মাটির কাজ করেন, এমন লোকের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
তবে সৃষ্ট শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের কাছ থেকে পাওয়া সম্মান ও ভালোবাসা প্রতিনিয়তই উৎসাহ জোগাচ্ছে বলে জানান বখতিয়ার। তাঁর কাছে জীবনের দর্শন হচ্ছে সহজ-সরল জীবনযাপন করা। জীবন মানে সুন্দর।
ফেসবুকে পণ্যের পোস্ট দেখে আগ্রহী ক্রেতা এবং পরিচিতজনেরা অর্ডার দিলে সে অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহ করেন বখতিয়ার। তাঁর কাজে সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়ে, স্ত্রী ও একজন বেতনভুক সহকারী সহযোগিতা করেন। তিনি মনে করেন, সঠিক পরিকল্পনা আর সহযোগিতা পেলে মৃৎশিল্পও পোশাকশিল্পের মতো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবে।
ফেরার সময় দরজার পাশের টেবিলে রাখা টেরাকোটায় চোখ আটকে যায় কিছুক্ষণের জন্য। সেখানে ইংরেজিতে লেখা ছিল, ‘সুইট হোম’।