‘ভিক্ষা করলে মাইনসে খারাপ কয়, তাই বাদাম বেচি’

ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে বাদাম বিক্রি করেন আল আমিন। শুক্রবার সকালে ময়মনসিংহ নগরের জয়নুল আবেদিন উদ্যানে
ছবি: প্রথম আলো

খুঁড়িয়ে হাঁটেন আল আমিন (৩২)। হাতে অ্যালুমিনিয়ামের বড় পাত্র। তাতে কিছু বাদাম। ভিক্ষাবৃত্তির পথ পাল্টে বাদাম বিক্রেতা তিনি। ময়মনসিংহ নগরের জয়নুল আবেদিন উদ্যানে আজ শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে ভিক্ষা করতাম। ভিক্ষা করলে মাইনসে খারাপ কয়, তাই বাদাম বেচি।’

আল আমিনের বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার কুমারগাতা ইউনিয়নের গারাইকুঠি গ্রামে। এ গ্রামের মৃত সোহরাব আলীর চার ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় আল আমিন। দুই বছর ধরে নগরের জয়নুল আবেদিন উদ্যান ও আদালতপাড়ায় বাদাম বিক্রি করেন। এখন বাদাম বিক্রি করলেও তিনি ভিক্ষাবৃত্তি করেছেন বেশ কয়েক বছর।

আল আমিন জানান, ১৮ বছর আগে ময়মনসিংহ নগরের বেগুনবাড়ি এলাকায় রাস্তা পারাপারের সময় ট্রাকচাপায় তাঁর ডান পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টানা তিন বছর বিছানায় পড়ে থাকতে হয় তাঁকে। চিকিৎসায় প্রায় ৯ লাখ টাকা খরচ হয়। বাবা চার কাঠা জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করায়। রডমিস্ত্রির কাজ করলেও দুর্ঘটনায় চিকিৎসা করে অভাবী হয়ে পড়েন তাঁরা। ভিক্ষাবৃত্তিতে নামতে বাধ্য হন। দুই বছর আগে বিয়ে করেছেন।

আল আমিন বলেন, ‘মানুষের কাছে হাতে পেতে ভিক্ষা নিলে মানুষ নানা খারাপ কথা বলে, তাই কয়েকজন লোকের পরামর্শে দুই বছর আগে বাদাম বিক্রি শুরু করি। আজ তিন কেজি বাদাম কিনে এনেছি ৯০০ টাকায়। সব বিক্রি করতে পালে পাঁচ থেকে ছয় শ টাকা লাভ হবে। প্রতিদিন ভোরে মুক্তাগাছা থেকে এসে বাদাম বিক্রি করে আবার বাড়ি ফিরে যাই।’

ভিক্ষাবৃত্তি লজ্জার জানিয়ে আল আমিন বলেন, ‘মানুষ বাদাম কিনে অতিরিক্ত পাঁচ টাকা দিতে চাইলেও এখন নিই না। গর্বের সঙ্গে বাঁচার চেষ্টা করি। যাঁরা ভিক্ষা করেন, তাঁরা ছোট ব্যবসা করে জীবন ভালোভাবে চালাতে পারেন।’

সাকিবের কাছ থেকে বুট-বাদাম কিনলে গান শোনায় শুনায় ফ্রিতে। ময়মনসিংহ নগরের জয়নুল আবেদিন উদ্যানে
ছবি: প্রথম আলো

‘মামা, একটা কিনলে গান শুনবেন ফ্রিতে’

হাতে কিছু বাদাম, মটর, বুট ও শুকনা বরই। জয়নুল আবেদিন উদ্যানে হাঁটছে কিশোর মো. সাকিব (১৫)। কণ্ঠে মামা একটা কিনলে গান শুনবেন ফ্রিতে। তার কাছে থাকা পণ্য প্রতি প্যাকেট ১০ টাকায় বিক্রি করে। এ সময় এক প্যাকেট বাদাম কিনবেন একজন এ কথা বলতেই শুরু করে গান। গান তার নিজেরই লেখা। গানে গানে মায়ের মারা যাওয়া ও বাবার কাছ থেকে ভালোবাসা না–পাওয়ার কথা তুলে ধরে। গান চলে আর পণ্য বিক্রিও চলে।

সাকিব জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলায় নানার বাড়িতে বসবাস করত। ইসলামপুরের নাপিতেরচর গাইবান্ধা সুরুজ জাহান উচ্চবিদ্যালয়ে গত বছর অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। এখন আর পড়ালেখা করে না। তার যখন তিন বছর বয়স, তখন মা সুফিয়া খাতুন মারা যান। এরপর বাবা আবদুল হাফিজ বিয়ে করেন আবার। নারায়ণগঞ্জে ফার্নিচার মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেন বাবা হাফিজ।

জয়নুল আবেদিন উদ্যানে আজ দুপুর ১২টার দিকে কথা হয় সাকিবের সঙ্গে। সে বলে, ‘খুব ছোটবেলায় মা মারা গেছে। অনেক কষ্টে বড় হচ্ছি। বাবা বলে টাকা ছাড়া ভালোবাসা নাই। তাই গত ১৫ দিন হলো নারায়ণগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ চলে এসেছি। ময়মনসিংহ নগরের শম্ভুগঞ্জ পাটগুদাম ব্রিজ মোড়ে এক ব্যক্তির কাছ থেকে বাদাম, মটর, বুট ও শুকনা বরই বিক্রি করি। বিক্রি করতে পারলে ভাতের জোগান হয়।’

সাকিব আরও বলে, ‘এগুলো বিক্রির পাশাপাশি মানুষকে গান শোনাই, গান শুনে যদি আমার জিনিসগুলো কিনে, আর কেউ কিছু টিপস দিলে সেগুলো নিই।’ সাকিব আরও বলে, ‘টাকা ছাড়া যেহেতু ভালোবাসা নাই, টাকা কামিয়েই বাবার কাছে যাব। আমার মা আমাকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেছে।’