কেরানীগঞ্জে রাতভর নির্যাতনে যুবকের মৃত্যু, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা
ঢাকার কেরানীগঞ্জে রাতভর মারধর ও নির্যাতন করে এক যুবককে হত্যার করা হয়েছে। নিহত যুবকের নাম রাসেল মিয়া (৩২)। এ ঘটনায় গতকাল বুধবার মামলা করেছেন ওই যুবকের বাবা। মামলায় স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আফতাব হোসেন ওরফে রাব্বিকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে আফতাব হোসেন ও তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন ‘আব্বা’ বাহিনীর ১৫ থেকে ২০ জন রাসেলকে হত্যা করেছে বলে তাঁর পরিবারের অভিযোগ। রাসেল বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার ভাষানচর গ্রামের বাসিন্দা তোফাজ্জল হাওলাদারের ছেলে। তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের খেজুরবাগ এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন।
এ ঘটনায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় করা মামলায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফতাব উদ্দিনসহ ১৩ জনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও ১০ থেকে ১২ জনকে। আফতাব শুভাঢ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বাছের উদ্দিনের ছেলে এবং ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শুভাঢ্যা ইউপি চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনের ভাতিজা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাবা শুভাঢ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তাঁর চাচা শুভাঢ্যা ইউপির চেয়ারম্যান হওয়ায় আফতাবের চলাফেরা বেপরোয়া। সব সময় বিশাল চাঁদাবাজ বাহিনী নিয়ে চলাফেরা করেন তিনি। তাঁরা কালিগঞ্জ, চরকালিগঞ্জ, তেলঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি করে আসছিলেন। বছরখানেক আগে আফতাব তাঁর বাবা ও চাচার বলয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পান। রাব্বির কার্যালয়ে নিয়মিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলে। নিহত রাসেলও আফতাবের পক্ষে চাঁদা আদায়ের কাজ করতেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তেলঘাট এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, আফতাবরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে রাসেলের পরিবারের কেউ কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না। বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে রাসেলকে নির্যাতনের বেশ কিছু ভিডিও ফুটেজ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ায় বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আফতাব উদ্দিনকে আহত অবস্থায় রাসেল বলছেন, ‘আব্বা, আপনি আমার বাপ। আব্বা, আব্বা, আব্বা আপনি আমাকে বাঁচান।’ এমন আকুতি অবস্থায়ও কয়েকজন যুবক রাসেলকে টানাহেঁচড়া করে পেছন দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। আরও একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রাসেল অচেতন অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছেন। এ অবস্থায়ও এক ব্যক্তি তাঁকে মারধর ও গালিগালাজ করছেন। আরও একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মেঝেতে রাসেলের নিথর দেহ পড়ে আছে। তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে নীলফুলা জখম ও নির্যাতনের চিহ্ন। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। তখন কেউ একজন নাকের রক্ত মুছে দিচ্ছেন।
ঘটনার পর থেকে ভীতসন্ত্রস্ত রাসেলের স্ত্রী সাথী আক্তার ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। এ বিষয়ে সাথী আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি। নিহত রাসেলের ছোট ভাই হৃদয় হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে রাসেলকে আফতাব উদ্দিন মুঠোফোনে কল দিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের তেলঘাট এলাকায় পারভীন টাওয়ারে তাঁর ব্যক্তিগত কার্যালয়ে যেতে বলেন। সেখানে যাওয়ার পর আফতাব ও তাঁর ১২ থেকে ১৫ জন সহযোগী রাতভর তাঁর ভাইকে পিটিয়ে নির্যাতন করেন। রাসেল ঘটনাস্থলে মারা যান।
হৃদয় হোসেন আরও বলেন, ‘ভোরের দিকে রাব্বী (আফতাব উদ্দিন) ও তাঁর বাহিনী রাসেল ভাইয়ের লাশ একটি বস্তায় ভরে খেজুরবাগ এলাকায় ভাইয়ের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাঁর স্ত্রী সাথী আক্তারের কাছে দিয়ে আসে। এ সময় তারা ভাবিকে হুমকি দেয়, এ বিষয়ে মুখ খুললে প্রাণে মেরে ফেলবে। এরপর রাব্বীর বাবা শুভাঢ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বাছের উদ্দিনের বাসায় এসে তাঁর লোকজনের মাধ্যমে ভাইয়ের লাশ দাফনের চেষ্টা করেন। পরবর্তী সময়ে পুলিশ সংবাদ পেয়ে বাসায় এসে ভাইয়ের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠায়। ময়নাতদন্ত শেষে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে কালীগঞ্জ কবরস্থানে ভাইয়ের লাশ দাফন করা হয়।’
এ বিষয়ে আজ সকালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কালিগঞ্জ বড় মসিজদ সড়ক এলাকায় অভিযুক্ত স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আফতাব হোসেনের বাড়িতে গেলে তাঁর বাসার দারোয়ান বলেন, ‘এখন কেউ বাসায় নেই। কী ঘটেছে, সে বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’
ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শুভাঢ্যা ইউপির চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘যে মারা গেছেন, সে ব্যক্তি চাঁদাবাজ ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অপকর্মের অনেক অভিযোগ রয়েছে। রাব্বির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে।’
এ ঘটনায় হত্যা মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুব আলম। তিনি বলেন, কী কারণে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে, সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালানো হচ্ছে।