আশ্রয়শিবিরে হানাহানি বন্ধ চেয়ে এবং দ্রুত আরাকানে ফেরার আকুতি জানিয়ে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-১ পশ্চিম) বড় সমাবেশ করেছেন রোহিঙ্গারা। আজ বুধবার সকাল ১০টায় আশ্রয়শিবিরের ই-৬ ব্লকসংলগ্ন খেলার মাঠে এ সমাবেশে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অংশ নেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যক্তি ছিলেন রোহিঙ্গা শিক্ষক-শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম ও যুব সংগঠনের সদস্য।
সকাল ১০টায় রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদের সভাপতিত্বে সমাবেশ শুরু হয়। ততক্ষণে বিশাল মাঠ কানায় কানায় ভরে যায়। উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবির থেকে মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও মসজিদের ইমামেরা দল বেঁধে সমাবেশে যোগ দেন। অধিকাংশ রোহিঙ্গার পরনে ছিল পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। সমাবেশে বক্তব্য দেন রোহিঙ্গা নেতা ও শিক্ষক আবু আলম, আবদুল রহিম, মোহাম্মদ জুবায়ের, রহমত করিম, আনোয়ার সাদেক, মুজিবুর রহমান প্রমুখ। সমাবেশে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন যুব সংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ বলেন, ‘আমরা যারা সমাবেশে হাজির হয়েছি, সবাই আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা। অধিকাংশই মুফতি ওলামায়ে কেরাম ও শিক্ষার্থী। আমরা আশ্রয়শিবিরে শান্তিতে বসবাস করতে চাই এবং নিরাপদে নিজ দেশ মিয়ানমারের আরাকান (রাখাইন) রাজ্যের জন্মভূমিতে ফিরে চাই। আর সে জন্য রোহিঙ্গাদের ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন। কোন পথে জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়া যায়, সেই পথ খুঁজে নিতে হবে। তার জন্যই এ সমাবেশ।’
রোহিঙ্গা শিক্ষক রহমত উল্লাহ বলেন, ‘আমরা আশ্রয়শিবিরে হানাহানি খুনোখুনি চাই না, দ্রুত মিয়ানমারে ফিরতে চাই। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি আমাদের অনুরোধ, রোহিঙ্গাদের জন্মভূমিতে ফিরতে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম দ্রুত শুরু করুন। আমরা দল বেঁধে যেভাবে এসেছি, প্রয়োজনে সেভাবে ফিরতে চাই।’
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। গত সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। এর কারণ ব্যাখ্যা করে সমাবেশে মাদ্রাসাশিক্ষক আবদুর রহিম বলেন, ‘মানবিক কারণে বাংলাদেশ সরকার ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। বিনা মূল্যে খাদ্যসহায়তা দিচ্ছে জাতিসংঘসহ দাতাগোষ্ঠী। কিন্তু আমরা (রোহিঙ্গারা) আশ্রয়শিবিরে ঠিকঠাক থাকতে পারছি না। আশ্রয়শিবিরের নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাদের একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী গোলাগুলিসহ সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। হতাহতের ঘটনা ঘটছে। তাতে সাধারণ রোহিঙ্গারা নিরাপত্তাহীন। আমরা আশ্রয়শিবিরে আর সন্ত্রাস চাই না, খুনোখুনি চাই না।’
সমাবেশে রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় নেতারা তিনটি বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার অঙ্গীকার করেন। প্রথমত, উখিয়া ও টেকনাফ ৩৩টি আশ্রয়শিবিরের যত মাদ্রাসা-মক্তব আছে, তার সব মুফতি ও ওলামায়ে কেরামরা সাধারণ রোহিঙ্গাদের মতো বিচার ও অধিকারের প্রশ্নে একতাবদ্ধ থাকবেন। দ্বিতীয়ত, প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে সাধারণ রোহিঙ্গাদের সচেতন করতে মসজিদ-মাদ্রাসাতে ধর্মীয় নেতারা প্রচারণা চালাবেন। রোহিঙ্গাদের উদ্বুদ্ধ করবেন। ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে যথোপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। তৃতীয়ত, আরাকান তথা রাখাইন রাজ্য স্বাধীন করার জন্য বাংলাদেশে আশ্রয়শিবিরে থেকে নয়, রাখাইন রাজ্যে গিয়ে রক্ত দিয়ে, যুদ্ধ করে স্বাধীন করতে হবে।
পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হওয়া সমাবেশ বেলা সাড়ে ১১টায় শেষ হয় ইসলামিক সংগীত ও মোনাজাতের মাধ্যমে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা জানান, আশ্রয়শিবিরে মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) শক্ত অবস্থান রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার ও মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দুই পক্ষের বিরোধের জেরে আশ্রয়শিবিরে পরিকল্পিতভাবে ২৫টি বেশি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটানো হয়। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৬১৯টি রোহিঙ্গার বসতি (ঘর) পুড়ে ভস্মীভূত হয়। আগুনে পুড়ে মারা গেছেন দুই রোহিঙ্গা। মূলত সশস্ত্র গোষ্ঠীর সন্ত্রাসীদের সতর্ক করতেই আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের মসজিদ-মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্র ও ইমামেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আজ প্রথমবারের মতো সমাবেশের ডাক দেন। আশ্রয়শিবিরগুলোয় অন্তত তিন হাজার মাদ্রাসা মক্তব ও মসজিদ রয়েছে। শিক্ষার্থী তিন লাখের বেশি। সাধারণ রোহিঙ্গারা ধর্মীয় নেতাদের নির্দেশনা মেনে চলেন।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আরিফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে রোহিঙ্গাদের সমাবেশ সম্পন্ন হয়েছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরে খুনোখুনি-সংঘাত চান না, দ্রুত মিয়ানমারে ফিরতে চান। এ জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা চেয়েছেন।
আশ্রয়শিবিরে হঠাৎ রোহিঙ্গাদের বড় সমাবেশ প্রসঙ্গে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) ও অতিরিক্ত সচিব মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আশ্রয়শিবিরগুলোয় মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা বেড়ে গিয়েছিল। গত ছয় বছরে সশস্ত্র গোষ্ঠীর গুলি ও হামলাতে ২০৩ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। আশ্রয়শিবিরের শান্তিশৃঙ্খলা-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষে কাজ চলছে। রোহিঙ্গাদের সচেতন করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা শিক্ষক-ছাত্র ও বিভিন্ন যুব সংগঠন মিলে সমাবেশের ডাক দেন। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা সাড়া দিয়েছেন। তাঁরা আশ্রয়শিবিরে আর সন্ত্রাস-খুনোখুনি দেখতে চান না।
আশ্রয়শিবিরের অতীত কর্মকাণ্ড তুলে ধরে প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, ধর্মীয় নেতা-শিক্ষার্থীসহ সাধারণ রোহিঙ্গারা সতর্ক-সচেতন হওয়ায় আশ্রয়শিবিরে খুনোখুনি-সংঘর্ষ কমে এসেছে। গত ২৭ অক্টোবর থেকে আশ্রয়শিবিরগুলোয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলি কিংবা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। নভেম্বর মাসে দুজন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে পাহাড়ধসসহ অন্য বিরোধে। ডিসেম্বরে হতাহতের ঘটনাও নেই।
আশ্রয়শিবিরে বাসিন্দা ও আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের সভাপতি মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, রোহিঙ্গারা শান্তি চান, নিরাপদে জন্মভূমিতে ফিরতে চান। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা ঐক্যবদ্ধ।