চলনবিলে যশোধনের দিঘি
স্বাদুপানির অধিকাংশ মাছ পাওয়া যেত বলে একসময় চলনবিলকে ‘মৎস্যখনি’ নামে ডাকা হতো; কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিলের আয়তন যেমন কমেছে, তেমনি বর্ষা ছাড়া অন্য মৌসুমে অথই জলরাশির দেখা মেলে না। আগের মতো মাছ আর নেই। এভাবে মাছ বিলুপ্ত হতে দেখে এগিয়ে এসেছেন এক ব্যক্তি, যাঁর প্রচেষ্টায় তিন জেলাজুড়ে বিস্তৃত বিলটির মাছ রক্ষায় সরকারও উদ্যোগী হয়েছে।
দুই যুগ আগের কথা। পাখির আশ্রয় ও খাদ্য নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়ে আলোচিত হন নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বাসিন্দা যশোধন প্রামাণিক। তাঁর উদ্যোগে সাড়া দিয়ে পাখির জন্য লোকালয় ও উন্মুক্ত জলাধারের আশপাশে গাছ লাগানো শুরু হয়। লোকালয়ের গাছপালায় পাখির জন্য মাটির হাঁড়ি বাঁধা, খাদ্য ও পানি সরবরাহ করার মতো কর্মসূচিও গ্রহণ করা হয়।
এরপর পাখির পাশাপাশি দেশি মাছ কীভাবে রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন যশোধন। প্রথমেই তাঁর মাথায় আসে চলনবিলের কথা। ভাবনা অনুযায়ী বিলের নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করেন। সংগৃহীত তথ্য–উপাত্ত নিয়ে দ্বারস্থ হন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। দেশি মাছ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং এ জন্য প্রকল্প প্রণয়নে সরকারের কাছে সুপারিশ তুলে ধরেন।
যশোধন প্রামাণিক সরকারের নীতিনির্ধারকদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, দেশি প্রজাতির অধিকাংশ মাছের বিচরণ উন্মুক্ত জলাধারে। কিছু নিয়মনীতি থাকলেও স্থানীয় লোকজন উন্মুক্ত জলাধারে অবাধে মাছ শিকার করেন। বর্ষা মৌসুমে চায়না দুয়ারী ও সোতি জাল দিয়ে মাছ শিকার করা হয়। এতে মাছের ডিম থেকে শুরু করে মা মাছ পর্যন্ত কোনো কিছু রেহাই পায় না। আর শুকনা মৌসুমে বিলের পানি সেচে মাছ নিধন চলে। এতে মা মাছসহ সব ধরনের মাছ বিলুপ্ত হয়।
সরকার চলনবিলের বিশেষ কিছু জায়গাকে মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা করলেও তা তেমন কাজে আসছে না। অভয়াশ্রম নদী বা বিলের উন্মুক্ত জলাধারের সঙ্গে একাকার হয়ে থাকায়, পানি কমে যাওয়া ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশি মাছ সংরক্ষণে পুরোপুরি কাজে আসছে না। তাই বিল বা নদীসংলগ্ন স্থানে কৃত্রিম জলাধার খনন করে দেশি মাছ সংরক্ষণের কৌশল তুলে ধরেন এই প্রকৃতি পর্যবেক্ষক। তাঁর কোনো সংগঠন নেই। তিনি মাঠেঘাটে ঘুরে প্রাণিকুলের প্রয়োজন বুঝতে চেষ্টা করেন। এ নিয়ে সরকারকে তথ্য–উপাত্ত সরবরাহ করেন।
যশোধন প্রামাণিকের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার পর বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পারে সরকার। এরপর সরকারি অর্থায়নে চলনবিলের নাটোর অংশের দুটি স্থানে দেশি মাছ সংরক্ষণে ৩৬ বিঘা আয়তনের দুটি দিঘি খনন করা হয়েছে।
দিঘি খননে ব্যয় হয়েছে ৮৮ লাখ টাকা। বর্ষার সময় এসব দিঘি বিলের পানির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। বর্ষা শেষে বিলের পানি শুকাতে থাকলে দেশি মাছ আশ্রয় নেয় দিঘিতে। পুরো শুকনা মৌসুমে নানা প্রজাতির মাছ এখানে থাকে। বসবাস নির্বিঘ্ন করতে দিঘিতে পাহারাদার ও কৃত্রিম পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
বর্ষার পানি দিঘিতে ঢুকতে শুরু করলে মা মাছগুলো ডিম ছাড়তে শুরু করে। ডিম থেকে কোটি কোটি পোনা উৎপাদিত হয়। এসব পোনা সারা বিলে ছড়িয়ে পড়ে। পানি কমতে থাকলে মাছগুলোর একটি অংশ আবার দিঘিতে ফিরে আসে। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মা মাছগুলো দিঘি দুটিতে আশ্রয় নেয়। নির্দিষ্ট সময় বসবাস করায় স্থানীয়ভাবে দিঘি দুটি ‘মাছের হোটেল’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
যশোধন প্রামাণিকের মতে, চলনবিলে খনন করা এসব দিঘি বিলের মাছের বসবাসের জন্য একেকটি হোটেল। যত দিন বসবাসের প্রয়োজন হয়, তত দিন তারা এখানে বসবাস করে। সময়মতো আবার চলেও যায়। আর পাখিরা সারা দিন বিলের পানিতে খাবার সংগ্রহ করে এবং রাতে দিঘির পাড়ের গাছে আশ্রয় নেয়।
দেশি মাছের নির্বিচার নিধন ঠেকাতে যশোধন প্রামাণিকের প্রচেষ্টায় গড়া দিঘি অনন্য অবদান রাখবে— এমনটি মনে করেন চলনবিল জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম। আর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদের বক্তব্য, এখনো যে ১৪০ প্রজাতির দেশি মাছ রয়েছে, তা রক্ষা করতে এ ধরনের বিশেষ উদ্যোগ কাজে আসবে। মৎস্যভান্ডার হিসেবে চলনবিল দীর্ঘজীবী হবে।