নদী–পাহাড় নিয়ে নেত্রকোনার দুর্গাপুরের হাতছানি

নেত্রকোনার দুর্গাপুরের চিনামাটির পাহাড়ফাইল ছবি : প্রথম আলো

সুসং দুর্গাপুর। আঁকাবাঁকা পথ, সারিবদ্ধ পাহাড়-টিলা আর নদীর ছড়াবেষ্টিত এক বৈচিত্র্যময় জনপদ। ভারত সীমান্তের কূল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা নেত্রকোনার উপজেলা এটি। ২৭৯ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ উপজেলা ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি আর সংস্কৃতির সংমিশ্রণে এক অপরূপ লীলাভূমি।

গারো পাহাড়ের স্তরে স্তরে লুকিয়ে আছে নানা রঙের চিনামাটি, ঝরনার মতো বয়ে চলা সোমেশ্বরী নদীর জলধারা-সিলিকা বালুর চরাচর, সুসং রাজবাড়ি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি, গারো ব্যাপ্টিস্ট কনভেনশন (জিবিসি), কমলা রানীর দিঘি, রানীখং মিশন, হাজং মাতা রাশিমণির স্মৃতিসৌধ, কমরেড মণি সিংহ স্মৃতিসৌধসহ নানা কিছু।

স্রোতস্বিনী নদী সোমেশ্বরী

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিষ্ণুরীছড়া, বাঙাছড়া প্রভৃতি ঝরনাধারা ও পশ্চিম দিক থেকে রমফা নদীর স্রোতোধারা এক হয়ে সোমেশ্বরী নদীর সৃষ্টি। একসময় নদীটি ‘সিমসাং’ নামে পরিচিত ছিল। ৬৮৬ বঙ্গাব্দে সোমেশ্বর পাঠক নামের একজন এই অঞ্চল দখল করে নেওয়ার পর থেকে নদীটি সোমেশ্বরী নামে পরিচিতি পায়। নদীর বিরিশিরি সেতুতে দাঁড়িয়ে তাকালে চোখে পড়ে গারো পাহাড়ের সারি, সবুজের সমারোহ। সেই নিরিবিলি পাহাড়ি প্রকৃতির কোলজুড়ে ছুটে চলে সোমেশ্বরীর স্বচ্ছ পানি। বর্ষাকালে পাহাড় থেকে নেমে আসা সোমেশ্বরীর স্রোতের সঙ্গে বয়ে আনে বালু, নুড়িপাথর আর কয়লা। এসব এখানকার মানুষের জীবিকার উৎস। সিলিকা নামের এই বালু নির্মাণশিল্পে ব্যবহৃত হয়। তবে অপরিকল্পিতভাবে শত শত অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালু–পাথর তোলার কারণে সোমশ্বরীর বর্তমান দশা খুবই খারাপ।

নেত্রকোনার সোমেশ্বরী নদী
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি

সোমেশ্বরী নদীর দক্ষিণ কূল ঘেঁষে দুর্গাপুর উপজেলার ছোট একটি ইউনিয়নের নাম বিরিশিরি। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে আদিবাসী গোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চার প্রতিষ্ঠান ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি’। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৭ সালে স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহে বসবাসরত গারো, হাজং, হদি, কোচ, বানাই, ডালুসহ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিলুপ্তপ্রায় ভাষা, সংস্কৃতি–ইতিহাস সংরক্ষণে কাজ করে যাচ্ছে।

কমলা রানী দিঘি

বিরিশিরি ইউনিয়ন পরিষদের পাশে কমলা রানী দিঘি। দিঘিটি সোমেশ্বরী নদীতে বিলীন হয়ে গেলেও এর দক্ষিণ–পশ্চিম পাড় এখনো কালের সাক্ষী হয়ে আছে। পাড়টিতে শতাধিক আদিবাসী পরিবার যুগ যুগ ধরে বসবাস করছে। জনশ্রুতি আছে, ১৫ শতকের শেষ দিকে সুসং দুর্গাপুরের রাজা জানকি নাথ বিয়ে করেন কমলা দেবী নামের এক নারীকে। কমলা রূপে–গুণে যেমন ছিলেন, ছিলেন পরম ধার্মিকও। রাজা জানকি নাথও ছিলেন প্রজাহিতৈষী। তাঁদের ছেলে রঘুনাথের জন্ম হলে প্রজাদের কল্যাণে পানির অভাব দূর করতে একটি পুকুর খনন করা হয়। কিন্তু পুকুরে পানি উঠল না। একরাতে রাজা স্বপ্নে দেখেন, কমলা দেবী যদি পুকুরের মাঝখানে গিয়ে পূজা দেন, তাহলে পানি উঠবে। কমলা পূজায় বসলে পানি উঠতে শুরু করে। একপর্যায়ে রানি পানিতে তলিয়ে যান।

জমিদারবাড়ি

দুর্গাপুর একসময় ছিল সুসং রাজ্যের রাজধানী। সোমেশ্বর পাঠক থেকে শুরু করে পরবর্তী বংশধরেরা প্রায় ৬৬৭ বছর এ রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু রাজকৃষ্ণ নামের এক রাজার শাসনামলে রাজপরিবারে রাজ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত। ফলে গোটা রাজ্য চারটি ভাগে ভাগ হয়ে যায় এবং চারটি পৃথক রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাড়িগুলো হলো বড় বাড়ি, আবু বাড়ি, মধ্যম বাড়ি ও দু’আনি বাড়ি। বর্তমানে এসবের ভংগ্নাবশেষ আছে। দু’আনি বাড়িতে সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

চিনামাটির পাহাড়

কুল্লাগড়া ইউনিয়নে গারো পাহাড়ের অন্তর্গত একটি টিলাবেষ্টিত এলাকা বিজয়পুর। এর খুব কাছেই ভারতের সীমানায় আছে সুউচ্চ গারো পাহাড়। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর ১৯৫৭ সালে ভেদিকুড়া এলাকায় প্রথম এই সাদামাটির সন্ধান পায়। ১৯৬৮ সাল থেকে মাটি উত্তোলনের কাজ শুরু হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইজারা নিয়ে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সাদামাটি তুলেছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করে করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ মাটি তোলার কাজ বন্ধের নির্দেশ দেন।

পাহাড়–নদী সৌন্দর্য ছড়ায় নেত্রকোনার দুর্গাপুরে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

সাদামাটি এলাকাটি এখন পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিত। সেখানে কালো, খয়েরি, বেগুনি, নীলসহ আরও কয়েক রঙের মাটির স্তর আছে। খনন করা এলাকাগুলো পরিণত হয়েছে নীল পানির লেকে। প্রতিদিনই দূরদূরান্তের পর্যটকেরা ভিড় করেন। ২০২১ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই পণ্য) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এই মাটি।

হাজং মাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ

বহেরাতরী গ্রামের সড়কের পাশে ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত তির–ধনুক আকৃতির স্মৃতিসৌধটি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আন্দোলন–সংগ্রামের গৌরবময় অতীত সম্পর্কে জানান দেয়। সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত বগাঝরা গ্রামটি ছিল ব্রিটিশবিরোধী গ্রামগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেই গ্রামের একজন প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন রাশিমণি। তিনি টংক প্রথা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। ১৯৪৬ সালে বহেরাতলী গ্রামের কিশোরী কুমুদিনী হাজংকে ব্রিটিশ পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে কৃষক সমিতির বিপ্লবী সদস্য রাশিমণি তাঁকে উদ্ধার করতে হাতে থাকা দা দিয়ে পুলিশকে কোপাতে থাকেন। পরে তিনি পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

টংক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ

সুসং জমিদারবাড়ির ভাগনে কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে জমিদারদের বিরুদ্ধে শুরু হয় টংক আন্দোলন। এই টংক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয় টংক আন্দোলন স্মৃতিসৌধ। দুর্গাপুর পৌর শহরে মহারাজা কুমুদ চন্দ্র মোমেরিয়াল (এমকেসিএম) পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠের পাশেই এই স্মৃতিসৌধ। প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর কমরেড মণি সিংহের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী মেলা বসে এখানে।