৯৫ ভাগ ভোট পেল আ.লীগ

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনপ্রতীকী ছবি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনার ছয়টি আসনের তিনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গে নৌকার প্রার্থীর মোটামুটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। বাকি তিনটি আসনের ভোটে একক আধিপত্য দেখিয়েছে নৌকা। জেলায় ৪৫ শতাংশের কম বৈধ ভোট পড়েছে। ছয়টি আসনের যে পরিমাণ বৈধ ভোট পড়েছে, তার ৯৫ শতাংশের বেশি গেছে নৌকার ৬ প্রার্থীসহ আওয়ামী লীগের ৩ স্বতন্ত্র প্রার্থীর ঝুলিতে।

খুলনার ৬টি আসনে মোট ভোটার ১৯ লাখ ৯৯ হাজার ৮৮২ জন। নির্বাচনী মাঠে লড়েছেন ৩৯ জন। জেলার ৬টি আসনে বৈধ ভোট পড়েছে ৮ লাখ ৮২ হাজার ১২১টি। জেলার মোট ভোটারের মধ্যে ৪৪ দশমিক ১১ শতাংশ বৈধ ভোট পড়েছে। এর মধ্যে নৌকা প্রতীকের ছয় প্রার্থী পেয়েছেন ৬ লাখ ৩৩ হাজার ১৩৭ ভোট। প্রদত্ত ভোটের ৭১ দশমিক ৭৭ শতাংশ পেয়েছেন নৌকার ৬ প্রার্থী। এ ছাড়া খুলনা-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা মোর্তজা রশিদী, খুলনা-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আকরাম হোসেন ও খুলনা-৬ আসনের প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জি এম মাহবুবুল আলম মিলে পেয়েছেন ২ লাখ ৫ হাজার ৪৪৪ (২৩ দশমিক ২৮ শতাংশ) ভোট; অর্থাৎ আওয়ামী লীগের ৯ নেতা মিলে খুলনার মোট প্রদত্ত ভোটের ৯৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন।

ফলাফল বিশ্লেষণ করে আরও দেখা গেছে, ৩৯ প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের ৬ জন বাদে জাতীয় পার্টিসহ অন্য ১০টি রাজনৈতিক দলের ২৩ প্রার্থী ভোট পেয়েছেন প্রদত্ত ভোটের ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এর মধ্যে আবার জাতীয় পার্টির ৬ প্রার্থী পেয়েছেন ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ ভোট। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি বাদে অন্য ৯টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা মিলে মোট ভোটের ২ শতাংশের কম ভোট পেয়েছেন।

নির্বাচন খুবই শান্তি ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়েছে। টাকার সঙ্গে ভালোবাসার প্রতিযোগিতায় ভালোবাসা জিতে গেছে।
নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, বিজয়ী প্রার্খী, খুলনা–৫

দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা-১। এলাকাটি হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত। ফলে বরাবরই আসনটি আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক। খুলনার অপর পাঁচটি আসন সময়ে-সময়ে বিভিন্ন হাতে পড়েছে। কিন্তু ১৯৯১ সাল থেকেই খুলনা-১ আসনে সব সময় জিতেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। জাতীয় সংসদের হুইপ পঞ্চানন বিশ্বাস এবার এখানে দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হন। এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান সাবেক সংসদ সদস্য ননী গোপাল মণ্ডল। আসনটিতে অন্য শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ননী গোপাল মণ্ডলই দ্বিতীয়বারের মতো ব্যাপক ভোটে জয়ী হয়েছেন। আসনটিতে ১১০টি কেন্দ্রে এবার মোট ভোটার ২ লাখ ৯০ হাজার ২৬৫। এই আসনে মোট ভোট পড়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩২৪। ভোট পড়ার হার ৫২ দশমিক ৮২। বৈধ ভোটের ৯২ দশমিক ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ওই আসনের নৌকার বিজয়ী প্রার্থী ননী গেপাল মণ্ডল।

আসনটিতে ননী গোপালের বাইরে সাবেক সচিব প্রশান্ত কুমার রায় (ঈগল), তৃণমূল বিএনপির গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক (সোনালী আঁশ) ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী কাজী হাসানুর রশিদ (লাঙ্গল) অংশ নেন। সবার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

ননী গোপাল মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিজয়ী হয়ে ভালো লাগছে। নির্বাচন আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে আরও ভালো লাগত।’

খুলনা-২ (সদর-সোনাডাঙ্গা) আসনে ১৫৭টি কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩ লাখ ২০ হাজার ২১৯। এখানে ভোট পড়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ১২টি। বৈধ ভোট পড়ার হার ৩৩ দশমিক ৭৩। বৈধ ভোটের ৯২ দশমিক ৪৬ শতাংশ ভোট পেয়ে ওই আসনে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিজয়ী হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই শেখ সালাহউদ্দীন। সালাহউদ্দীনের বিপরীতে ওই আসনে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। আসনের বাকি ৬ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

খুলনা-৩ আসনে (খালিশপুর-দৌলতপুর-খানজাহান আলী) আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন। ওই আসনে এবার মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছিলেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। ওই আসনের ১১৬টি কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ লাখ ৪৫ হাজার ৭০৯টি। ভোট পড়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৫টি। ভোট পড়ার হার ৪১ দশমিক ১৩। বৈধ ভোটের ৯০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন এস এম কামাল হোসেন। আসনটির বাকি তিন প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে।

এস এম কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোট গ্রহণের আগের রাতে আমার আসনের বিভিন্ন জায়গায় বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে, একটি কেন্দ্র আগুন দিয়ে জ্বালানো হয়েছে। সাধারণ মানুষ শত বিপত্তি উপেক্ষা করে ভোটকে উৎসবমুখর করেছেন, এ জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণের চেষ্টা করব।’

খুলনা-৪ (রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া) আসনে টানা তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন আবদুস সালাম মুর্শেদী। তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে ওই আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত এস এম মোস্তফা রশিদী সুজার ভাই এস এম মোর্তজা রশিদীর। আসনের ১৩৩টি কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩ লাখ ৫৫ হাজার ১৫৩টি। এর মধ্যে বৈধ ভোট পড়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার ২৩৮টি। বৈধ ভোট পড়ার হার ৪৩ দশমিক ৪২। আবদুস সালাম মুর্শেদী পেয়েছেন ৮৬ হাজার ১৯৪ ভোট আর মোর্তজা রশিদী পেয়েছেন ৬০ হাজার ৮৯৩ ভোট। বাকি ১০ প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন।

ভোট পড়ার হার দেখে বোঝা যায়, ভোটের মাঠে শুধু গিয়েছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা–কর্মী ও সমর্থকেরা।
কুদরত ই খুদা, সম্পাদক, খুলনা, সুজন

খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) আসনে টানা চতুর্থবারের মতো বিজয়ী হয়েছেন সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। এবার তাঁর সঙ্গে ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আকরাম হোসেনের শক্ত লড়াই হয়েছে। শেখ আকরাম হোসেন ফুলতলা উপজেলা পরিষদের চারবারের চেয়ারম্যান। আসনের ১৩৫টি কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩ লাখ ৮৩ হাজার ২১৯টি। এর মধ্যে বৈধ ভোট পড়েছে ২ লাখ ৬০ হাজার ৭৫টি। ভোট পড়ার হার ৫৩ দশমিক ৭৭। বিজয়ী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ পেয়েছেন ১ লাখ ১০ হাজার ২১৯ ভোট। আকরাম হোসেন পেয়েছেন ৯৩ হাজার ৭৭ ভোট। বাকি তিন প্রার্থীর জামানত গেছে।

নারায়ণ চন্দ্র চন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচন খুবই শান্তি ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়েছে। টাকার সঙ্গে ভালোবাসার প্রতিযোগিতায় ভালোবাসা জিতে গেছে।’

খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনে আওয়ামী লীগের মো. রশীদুজ্জামান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জি এম মাহবুবুল আলমের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। দলের নেতা-কর্মীরা দুই প্রার্থীর পক্ষে বিভক্ত হওয়ায় নির্বাচনী এলাকায় উত্তেজনা ছিল। শেষ পর্যন্ত মাহবুবুল আলমকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিজয়ী হন মো. রশীদুজ্জামান। রশীদুজ্জামান পেয়েছেন ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৯ ভোট। মাহবুবুল আলমের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ৫১ হাজার ৪৭৪। ওই আসনের মোট ভোটার ৪ লাখ ৫ হাজার ৩১৬টি। এর মধ্যে বৈধ ভোট পড়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৪০৭টি। বৈধ ভোট পড়ার হার ৩৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনার জেলা সম্পাদক কুদরত ই খুদা প্রথম আলোকে বলেন, এবারের নির্বাচনে হয়েছে অনেকটা একদলীয়। ভোট পড়ার হার দেখে বোঝা যায়, ভোটের মাঠে শুধু গিয়েছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা–কর্মী ও সমর্থকেরা। তাঁরা নির্দিষ্ট প্রতীকের বাইরে অন্য কাউকে ভোট দেবেন না, এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে সরকারের মদদপুষ্ট হয়ে যাঁরা নির্বাচন অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এলাকায় তেমন পরিচিত মুখ নন। এ কারণেই মানুষ তাঁদের ভোট দেননি।

কুদরত ই খুদা আরও বলেন, এবারের নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন না হওয়ায় অনেক ভোটার কেন্দ্রে যাননি।