হত্যাকাণ্ডের পর স্বাভাবিকভাবে ঘোরাফেরা করছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সজীব
কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীর চর থেকে ৯ টুকরা লাশ উদ্ধার হওয়া মিলন হোসেন (২৭) হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা এস কে সজীব। তিনি জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি (বহিষ্কৃত)। পাশাপাশি পুলিশের তালিকাভুক্ত কিশোর গ্যাং-প্রধান তিনি। এস কে সজীবের নেতৃত্বে কুষ্টিয়া শহরে একটি গ্যাং চলে।
বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতি করছেন তিনি। তবে কোনো পদ-পদবি নেই। এস কে সজীব জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাতের (তুষার) সঙ্গে থেকে রাজনীতি করেন।
গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে আজ শনিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সদর উপজেলায় পদ্মা নদীর চর থেকে নিহত মিলন হোসেনের লাশের ৯ টুকরা চারটি স্থান থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, চাঁদার দাবিতে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এস কে সজীবের নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ড ঘটে।
সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের পর এস কে সজীব শহরেই স্বাভাবিকভাবে ঘোরাফেরা করছিলেন। পুলিশ তাঁকেসহ চারজনকে শহর থেকে আটক করে হেফাজতে নেয়। অন্য তিনজন হলেন সদর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের কান্তিনগর গ্রামের জহির রায়হান ওরফে বাবু, সদরের কুমারগাড়া এলাকার ফয়সাল আহমেদ, হাউজিং এলাকার ইফতি খান।
ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এস কে সজীব কলেজে পড়ালেখা না করেও হঠাৎ করে ছাত্রলীগের পদ পেয়ে যান। ইয়াসির আরাফাত ও সাদ আহাম্মেদের নেতৃত্বাধীন কমিটিতে ২০১৭-১৮ সালের দিকে প্রথম সহসম্পাদকের পদ পান। তখন থেকেই শহরের হাউজিং এলাকায় কিশোর গ্যাং তৈরি করে এলাকায় চাঁদাবাজি, মারপিট, মাদকের কারবারসহ নানা অপকর্ম শুরু করেন। এরপরও নেতাদের সুপারিশে জেলা ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটিতে সহসভাপতির পদ পেয়ে যান তিনি। এরপর সজীব আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। শহরে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতে দেখা যায়। জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ হাফিজ চ্যালেঞ্জের ওপর হামলাসহ নানা অপকর্মের কারণে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ছাত্রলীগের নেতারা জানান, ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তুষারের হাত ধরে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন সজীব। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনের সময় নির্বাচনী প্রচারণায়ও অংশ নেন। সেখানে তাঁকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। ওই মঞ্চে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাত, সাধারণ সম্পাদক মানব চাকীসহ অন্য নেতারাও ছিলেন। তখন তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আগে আমি ছাত্রলীগ করতাম, এখন স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতি করি।’
দলের একটি সূত্র জানায়, এস কে সজীবকে নেতারা নানা অপকর্মে ব্যবহার করেন। তাঁর ক্যাডার বাহিনী আছে। মিছিল-মিটিংয়ে কিশোরদের নিয়ে আসেন। আগে ছাত্রলীগ করলেও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নতুন কমিটিতে তুষার সভাপতি হলে আবার তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় নানা অপকর্ম করে আসছিলেন। সর্বশেষ শুক্রবার রাতেও তুষারের সঙ্গে কুষ্টিয়া পলিটেকনিকে একসঙ্গে ছিলেন। এরপরই তাঁকে আটক করে পুলিশ।
ইয়াসির আরাফাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘সে (সজীব) আমার সঙ্গে রাজনীতি করে, এটা ঠিক। শুক্রবারও পলিটেকনিকে আমরা গিয়েছিলাম, তারাও ছিল। তার ব্যক্তিগত অপরাধের দায় সংগঠন নেবে না। সে দলে থেকে কোনো কিছু করেনি। বাড়িতে গিয়ে কী করেছে, সেটা তার দায়।’ বারবার অপকর্মের পরও তাঁকে কেন দলে নেওয়া হয়, জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিতে রাজি হননি।
পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, এস কে সজীবের নাম সজীব শেখ। তাঁর বাবার নাম মিলন শেখ। শহরের আড়ুয়াপাড়া এলাকার হরিবাসর এলাকায় তাঁদের বাড়ি। সজীবের নামে কুষ্টিয়া মডেল থানায় মাদক, চাঁদাবাজি, হামলাসহ নানা অভিযোগে পুরোনো সাতটি মামলা আছে। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে এক নারী ইন্টার্ন চিকিৎসককে মারধরের মামলায় তাঁর দুই বছরের সাজাও হয়েছিল।
গত বছর শহরের পিটিআই রোডে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ হাফিজ চ্যালেঞ্জকে গুরুতর আহত করা হয়। এর আগে শহরের সাদ্দাম বাজার এলাকা এক যুবককে ছুরিকাঘাত করার সময় তিনিও গুরুতর আহত হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় মামলাও হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপির কার্যালয় ও মিছিলেও তাঁর নেতৃত্বে একাধিকবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। শহরের হাউজিং এলাকায় চাঁদাবাজি ও হামলার একাধিক ঘটনা আছে। সেই সব ঘটনায় থানায় মামলাও হয়েছে।
সর্বশেষ মিলন হোসেনকে অপহরণ ও হত্যার মিশনে নেতৃত্ব দেন সজীবসহ তাঁর ৫ সহযোগী। পুলিশ সূত্র জানায়, হাউজিং এলাকায় তাঁদের একটি কার্যালয় আছে। সেখানে লোকজনকে ধরে এনে নির্যাতন করে চাঁদা আদায় করা হয়। শহরে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা আছে। নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় ছবি তুলে তিনি নিজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন।