সীতাকুণ্ডে যেভাবে রূপবান শিমে বাড়তি আয় করছেন কৃষক
পাহাড়ি ভূমিতে যত দূর চোখ যায় বিস্তর জায়গাজুড়ে ফুটে আছে রূপবান শিমের ফুল। কোথাও থোকা থোকা ঝুলছে বেগুনির রঙের শিম। আবার কোথাও থোকা থেকে সদ্য ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে। কৃষকদের কেউ কেউ বাজারে বিক্রির জন্য শিম তুলছেন। আবার কেউ শিমের লতা পরিচর্যায় ব্যস্ত।
এ চিত্র দেখা গেছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা ইউনিয়নের বড় কুমিরা পাহাড়ে। রূপবান জাতের এই শিম গ্রীষ্মকালে লাগানো হয় বলে একে গ্রীষ্মকালীন শিম বলা হয়।
সীতাকুণ্ড উপজেলা শিম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। সীতাকুণ্ডের শীতকালীন শিম বিশেষ করে ছুরি, লইট্টা, বাঁটা শিমের চাহিদা বেশি। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন শিমও সুস্বাদু ও লাভজনক হাওয়ায় দিন দিন এর চাষ বেড়ে চলেছে।
কৃষক পর্যায়ে যেখানে শীতকালীন শিম কেজি প্রতি বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৪০ টাকা, সেখানে গ্রীষ্মকালীন শিম কেজি প্রতি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১৫০ টাকায়। কারণ, গ্রীষ্মকালীন শিম যে সময়ে বাজারে আসে, সে সময় মূলত শিমের মৌসুম নয়।
কৃষকেরা বলছেন, গ্রীষ্মকালীন শিম ওঠার শুরুতে তাঁরা প্রতি কেজি বিক্রি করেছেন ১৬০ টাকা থেকে ১৭০ টাকা। এখনো ১৪০ টাকা দরে শিম বিক্রি হচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকাররা এসে এই শিম নিয়ে যাচ্ছেন। সীতাকুণ্ডে পাহাড়ের টিলায় শিম চাষ হয়। দুর্গম এলাকায় হাওয়ায় এর উৎপাদন খরচ কিছুটা বেশি। পাহাড়ের শিম চাষ করার অন্যতম কারণ হলো, বর্ষায় সমতলে অতি বৃষ্টির কারণে পানি জমে শিমের লতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু পাহাড়ে পানি জমে থাকে না। ফলে শিমগাছ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। পাহাড়ে এ শিমের চাষ বাড়তে থাকায় অনাবাদি জমির পরিমাণও কমছে।
কৃষকেরা জানিয়েছেন, গ্রীষ্মকালীন রূপবান শিমের ফলন শীতকালীন শিমের চেয়েও দীর্ঘ সময় ধরে পাওয়া যায়। ফলে এই শিমের লাভও বেশি।
উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ২০২১ সালে সীতাকুণ্ডে গ্রীষ্মকালীন শিমের চাষ হয়েছিল ২৫ হেক্টর জমিতে। পরের বছরও একই পরিমাণ জমিতে শিমের চাষ হয়েছিল। চলতি বছর তা বেড়ে ৩০ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন শিমের আবাদ হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কুমিরা ইউনিয়নের রেলওয়ের পুরোনো টিবি হাসপাতাল এলাকা থেকে পূর্ব দিকে অন্তত তিনটি পাহাড়ে ঢালু অংশে শিমের চাষ হয়েছে। পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচের দিকে ঢালু অংশে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে খুঁটি তৈরি করে মাচা তৈরি করা হয়েছে। এরপর প্রতিটি খুঁটির গোড়ায় তিনটি করে শিম গাছ লাগানো হয়েছে। সেগুলো থেকে এখন বেগুনি রঙের শিম ধরছে। প্রতিটি মাচায় এখন বেগুনি ফুলে ভরা। একদিকে শিম তুলছেন কৃষক অন্যদিকে ফুল আসছে।
কথা হয় কুমিরা পাহাড়ে কৃষক জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড়ে তাঁর ১৪ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদ রয়েছে। এর মধ্যে ৩ একর জমিতে শিম চাষ করেছেন তিনি। এতে প্রায় ৩ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। দুই মাস ধরে তিনি শিম বিক্রি করছেন। এখন পর্যন্ত দুই লাখেরও কিছু বেশি টাকার শিম বিক্রি করেছেন। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে আরও তিন মাস শিম বিক্রি করতে পারবেন। তবে বৃষ্টি হলে ফুল ঝরে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, গত শনিবার কুমিরা হাটে কেজিপ্রতি ১৪০ টাকা দরে ১০০ কেজি শিম বিক্রি করেছেন। প্রথম দিকে তিনি ১৬০ টাকা কেজি দরে শিম বিক্রি করেছিলেন। ধীরে ধীরে দাম কমছে।
সেখানে কথা হয় আরেক কৃষক আবদুল মোনাফের সঙ্গে, তিনি এক একর জমিতে শিম চাষ করেছেন।
এর আগে তিনি ৫০ শতক জমিতে শিমের আবাদ করেছিলেন। গত বছর ভালো দাম পেয়েছেন বলে এবার আরও ৫০ শতক জমিতে চাষ করেছেন তিনি।
উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, সীতাকুণ্ডে গ্রীষ্মকালীন রূপবান শিম চাষ করেছেন প্রায় ৩০০ কৃষক। কুমিরায় বেশির ভাগ পাহাড়ি এলাকায় রূপবান শিমের আবাদ হয়েছে। এ ছাড়া বাঁশবাড়িয়া, সৈয়দপুর, বারৈয়ারঢালা ও সীতাকুণ্ড পৌর সদরেও রূপবান শিমের আবাদ হয়েছে।
কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকেরা জানিয়েছেন, প্রতিবছর এপ্রিল মাসে গ্রীষ্মকালীন শিমের চাষ করা হয়। ৬০ দিনের মাথায় অর্থাৎ জুন মাস থেকে ফলন উত্তোলন করতে শুরু করে কৃষকেরা। এভাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন শিম বিক্রি হয়।
ডিসেম্বরে পানি–সংকটের কারণে রূপবান শিমের উৎপাদন কমতে থাকে। অন্যদিকে নভেম্বরের শেষের দিকে শীতকালীন শিম বাজারে আসতে শুরু করে।
আজ সকালে ছোট কুমিরা বাজার এলাকায় কথা হয় চট্টগ্রাম নগরের রিয়াজউদ্দিন বাজারের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কেজিপ্রতি ঘরে ১১০ টাকা করে তিনি ৭৮৫ কেজি কিনেছেন। এখন সেগুলো চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন কাঁচাবাজারে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে তাঁরা বিক্রি করবেন। জোগানের ওপর নির্ভর করে তাঁরা বাজারের দর ঠিক করেন।
কুমিরা ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুজন ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি হাটে (সপ্তাহে দুই দিন) তাঁর ইউনিয়ন থেকে অন্তত ১৫ টন শিম বিক্রি করেন কৃষকেরা। এখন ১৫ টন শিমের মূল্য ১৫ থেকে ১৮ লাখ টাকা। তাঁরা কৃষকদের নানাভাবে পরামর্শ দেন। বিশেষ করে ফুল আসার পর সেগুলো ধরে রাখার জন্য যেসব ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়, সেগুলো পরামর্শ দেন। পাহাড়ে গিয়ে বিভিন্ন সময় তাঁরা তদারক করেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হাবিবুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে ফলন উৎপাদন হয়।
শীতকালীন শিমের চেয়েও দাম বেশি পান। ফলে কৃষকেরা গ্রীষ্মকালীন শিমের চাষের দিকে ঝুঁকছেন।
ফলে প্রতিবছর বেড়ে চলছে এ শিমের আবাদ। সীতাকুণ্ডের শীতকালীন শিমের মতো রূপবান ছিল শিমও খুব সুস্বাদু। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে এর সুনাম রয়েছে।