যেখানে শায়িত অনেক শহীদ

সিলেট ক্যাডেট কলেজ এলাকায় শহীদ স্মৃতি উদ্যানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বাছির মিয়ার তিন সন্তান। গত মঙ্গলবার বিকেলে তোলাছবি: প্রথম আলো

পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ মাড়িয়েই জায়গাটিতে যেতে হয়। স্থানটি নির্জন সবুজ-শ্যামল। চারপাশ উঁচু-নিচু অসংখ্য টিলাঘেরা। এ রকমই একটি টিলায় অবস্থিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহীদ স্মৃতি উদ্যান’। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পুরোটা সময় মানুষদের ধরে এনে এখানে নারকীয় গণহত্যা চালিয়েছে পাকিস্তানি সেনারা। এর পর থেকেই জায়গাটি এলাকার নামে ‘সালুটিকর বধ্যভূমি ও গণকবর’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

সিলেট ক্যাডেট কলেজের পূর্ব পাশে বধ্যভূমির অবস্থান। এখানে একটি স্মৃতি উদ্যান তৈরির পরিকল্পনা নেন কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুস সালাম বীর প্রতীক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়া উদ্দিন আহমদ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানের অনুমতি নিয়ে সিলেট এরিয়া কমান্ডারের বিশেষ উদ্যোগে উদ্যানটি হয়। গত বছরের ৪ মার্চ এ উদ্যানের উদ্বোধন করেন শহীদ সৈয়দ সিরাজুল আব্দালের স্ত্রী সৈয়দা সাকিনা আব্দাল। শহীদ স্মৃতি উদ্যানটিতে ৬৬ জন শহীদের স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে।

গত মঙ্গলবার প্রথম আলোর অনুরোধে শহীদ স্মৃতি উদ্যানে আসেন শহীদ বাছির মিয়ার তিন সন্তান বিলাল আহমদ (৫৭), ইকবাল আহমদ (৫৪) ও তাহমিনা খাতুন (৫৩)। উদ্যানে তাঁদের বাবারও একটা নামফলক আছে। শহীদ বাছির মিয়ার সন্তানেরা জানান, ১৯৭১ সালে তাঁদের বাবা ছিলেন শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে ট্রেনিংও নেন। যুদ্ধে যোগ দেওয়ার অপরাধে স্থানীয় এক রাজাকারের ইন্ধনে পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের বাবাকে আটক করে। পরে এই বধ্যভূমিতেই তাঁদের বাবাকে হত্যা করা হয়।

স্মৃতি উদ্যানে এসেই বাছির মিয়ার সন্তানেরা বাবার নামফলকের সামনে যান। এ সময় তাঁরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরে সেখানেই তাঁদের সঙ্গে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের কথা হয়। ছলছল চোখে বাছির মিয়ার সন্তানেরা জানান, তাঁদের বাবা ঢাকায় ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলেন। পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি স্ত্রী-সন্তানদের বিয়ানীবাজার উপজেলায় রেখে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে ট্রেনিংয়ে যান। পরে বড় ছেলে হেলাল আহমদ অসুস্থ হয়ে পড়লে পরিবারের সদস্যদের সিলেট নগরের কামালগড় এলাকার নিজ বাসায় চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেন।

বাছির মিয়ার সন্তানেরা জানান, অসুস্থ ছেলেকে দেখতে ট্রেনিং থেকে একদিন তাঁদের বাবা সিলেট শহরে পৌঁছান। স্থানীয় এক রাজাকার বিষয়টি জানতে পেরে পাকিস্তানি সেনাদের খবর দেয়। পাকিস্তানি সেনারা বাছিরকে ধরে তৎকালীন সিলেট রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল (বর্তমান সিলেট ক্যাডেট কলেজ) নির্যাতনকেন্দ্রে এনে নির্যাতন করে। পরে তাঁকে স্কুলের পূর্ব পাশের টিলার বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এই বধ্যভূমিতেই অন্য আরও ৬৫ জন শহীদের সঙ্গে বাছিরের নামফলক বসানো হয়।

বাছিরের ছোট সন্তান তাহমিনা খাতুন বলেন, ‘২০১১-১২ সালের দিকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আবেদন করার পরও বাবার শহীদ স্বীকৃতি এখনো পাইনি। আমার আশি–ঊর্ধ্ব বৃদ্ধা মা তাঁর স্বামীর শহীদ স্বীকৃতি দেখার জন্য আকুল হয়ে আছেন। জানি না, তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হবে কি না!’

জানা গেছে, সিলেট শহর, শহরতলিসহ বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিকামী মানুষদের পাকিস্তানি সেনারা ধরে এনে সিলেট রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল নির্যাতনকেন্দ্রে বন্দী করে অমানুষিক নির্যাতন চালাত। কাউকে জানালার গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে, কারও শরীরে আলপিন গেঁথে, কাউকে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে নির্যাতন করা হতো। পরে স্কুলের পার্শ্ববর্তী টিলায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হতো। এ নির্যাতনকেন্দ্রে অনেক নারীকে এনে দলবদ্ধ ধর্ষণও করেছে পাকিস্তানি সেনারা।

বধ্যভূমিটিকে স্মৃতি উদ্যানে পরিণত করার পেছনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক অপূর্ব শর্মার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর গবেষণায়ই বধ্যভূমিতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া শহীদদের মধ্যে ৬৬ জনের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা খুঁজে পাওয়া গেছে। অপূর্ব শর্মা বলেন, দীর্ঘ অনুসন্ধানে ৬৬ জন শহীদের নাম পাওয়া যায়। আরও কয়েকজন শহীদের নাম পাওয়া গেছে, তাঁদের নামও স্মৃতিফলকে সংযোজন করা হবে। তবে এই বধ্যভূমিতে হাজারো মানুষ শহীদ হয়েছেন। এসব শহীদের অনেকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের স্বীকৃতি পাননি। তাঁদের স্বীকৃতি প্রদানে সরকার যেন উদ্যোগী হয়।