পরিবারে ছিল অর্থাভাব। কারও বাবা কৃষিশ্রমিক, কারও বাবা ইটভাটার শ্রমিক। কারও বাবা অসুস্থ থাকায় মা গৃহপরিচারিকার কাজ করে সংসার চালান। এমন সব পরিবার থেকে উঠে এসে এই অদম্য শিক্ষার্থীরা মেধার স্বাক্ষর রেখেছে এবারের এসএসসি পরীক্ষায়। সবাই জিপিএ-৫ পেয়েছে। এত দিন তারা নিজেই টিউশনি বা কৃষিশ্রমিকের কাজ করে পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছে। তবে এখন কলেজে পড়াশোনার খরচ জোগানো নিয়ে চিন্তায় পড়েছে এই মেধাবীরা।
কাজ করে টাকা জমায় সাগর
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী সাগর কুমার ওঁরাওয়ের বাবা কৃষিশ্রমিক, মা গৃহিণী। বাবার স্বল্প আয়ে সংসার চলে না বলে মাকেও প্রায়ই অন্যের খেতে দৈনিক মজুরিতে কাজ করতে হয়। সাগরও পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে কৃষিশ্রমিকের কাজ করেছে। সেই টাকায় লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছে। এমন টানাপোড়েনের সংসারে সাগর এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে।
বিজ্ঞানের ছাত্র সাগরদের বাড়ি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়নের খোর্দ মাধাইনগর গ্রামে। তাঁর বাবা নীপেন্দ্রনাথ ও মা সান্ত্বনা রানী। দুই ভাইয়ের মধ্যে সাগর বড়। ছোট ভাই শাওন কুমার ওঁরাও ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। সাগর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল নিমগাছি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে।
সাগরের বাবা নীপেন্দ্রনাথ বলেন, ‘ছেলেটার পড়ালেখার খরচ জোগানো নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছি।’ মা সান্ত্বনা রানী বলেন, ‘ছেলেটা পড়ালেখায় ভালো। কিন্তু তাকে কিছু দিতে পারি না।’
সাগর বলে, ‘বাবা-মায়ের সঙ্গে আমিও মাঠে কাজ করতাম। তবে আমরা বয়সে ছোট বলে মজুরি কম পেতাম। তবু পড়াশোনার জন্য মাঠে কাজ করে টাকা জমাই। একটু সহযোগিতা পেলে এইচএসসি পর্যায়ে পড়াশোনা এগিয়ে নিতে পারতাম।’
নিমগাছি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, সমাজের হৃদয়বান মানুষ এগিয়ে এলে সাগর কুমার ওঁরাওয়ের মতো অদম্য মেধাবীদের পড়ালেখা নিয়ে দুশ্চিন্তা দূর হবে।
টিউশনি করেছে বিপাশা
বিপাশা রানী রায়ের বাবা বিমল চন্দ্র রায় ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করেন। ধান, গম, ভুট্টা ও পাট কাটার মৌসুমে কৃষিশ্রমিকের কাজ করেন। মা শোভা রানী গৃহিণী। ৫ শতক জমির ওপর তাঁদের ভিটাবাড়ি। দুই ভাই-বোনের মধ্যে বিপাশা ছোট। তার বড় ভাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সে পড়াশোনা করছেন। পাশাপাশি তিনি আলুর আড়তে কাজ করেন। বিপাশা এবার এসএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
বিপাশাদের বাড়ি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার দলগ্রাম ইউনিয়নের গেগড়া গ্রামে। এবার কালীগঞ্জের তুষভান্ডার নছর উদ্দিন সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে বিপাশা।
বিপাশা জানায়, পড়াশোনার খচর জোগাতে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছে। সেই সঙ্গে বড় ভাই আড়তে কাজ করে পড়াশোনার খরচ দিয়েছেন। বিপাশা বলে, ‘ভালো মানের কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনা করতে চাই। ভবিষ্যতে একজন চিকিৎসক হতে চাই।’
তুষভান্ডার নছর উদ্দিন সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. রবিউল ইসলাম বলেন, বিপাশাকে কলেজে পড়ানো তার দরিদ্র বাবার পক্ষে সম্ভব নয়।
শিশুদের পড়িয়েছে আশরাফি
বাবা আজারুল ইসলাম কসাইখানায় মাংস কাটার কাজ করেন। মা এসেদা বেগম গৃহিণী। টাকার অভাবে অষ্টম শ্রেণিতে একবার আশরাফির লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। লেখাপড়ার খরচ চালাতে আশরাফি সেই থেকে শিশুদের পড়ানো শুরু করে। সেই টাকায় লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে আশরাফি আক্তার এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের কসাইপাড়া গ্রামে আশরাফিদের বাড়ি। তারা দুই বোন। অভাবের মধ্যেই দুজনেই লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। আশরাফি এবার বরাতি উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল।
আশরাফির মা এসেদা বেগম বলেন, ‘ছাওয়াগুলা ছোট থাকি গ্রামের ওয়ান, টুর বাচ্চাক পড়েয়া নিজের পড়ার খরচ চালাইছে। বেটিটা এবার ম্যাট্রিক পরীক্ষায় এ-প্লাস পাইসে। ওয় চায় ভালো কলেজত পড়বার। কিন্তুক ওক পড়ার টাকা, বই কিনার টাকা দিবার সামর্থ্য যে মোর নাই।’
আশরাফি বলে, ‘আমার স্বপ্ন চিকিৎসক হব। কিন্তু বাবার যে আয়, তাতে আমাদের সংসার চলে না। তার ওপর দুই বোনের লেখাপড়ার খরচ। জানি না কত দূর এগোতে পারব।’
বরাতি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেকেন্দার আলী বলেন, আশরাফি ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় ভালো। পারিবারিক অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে তাঁর কাছ থেকে স্কুলের ফি নেওয়া হয়নি। কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে মেয়েটা অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
গৃহপরিচারিকার মেয়ের চমক
লাবনী আক্তারের বাবা মামুন মিয়া আগে ঢাকায় মাছের আড়তে কাজ করতেন। কিন্তু গত বছর অসুস্থ হয়ে বাড়িতে চলে আসেন। এখন কোনো কাজ করতে পারেন না। তাই পরিবারে এখন একমাত্র উপার্জনকারী তার মা রাজিয়া বেগম। তিনি গৃহপরিচারিকার কাজ করে মেয়েকে পড়িয়েছেন। বিজ্ঞানের ছাত্রী লাবনী এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে।
লাবনীদের বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কলসপাড় ইউনিয়নের গোল্লারপাড় গ্রামে। লাবনীর চাচার ২ শতাংশ জমিতে ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছে তার পরিবার। লাবনী বলে, ‘আমার স্বপ্ন চিকিৎসক হওয়ার। এ জন্য বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে হলে জেলা শহরের কলেজ ভালো। কিন্তু এখন কলেজে ভর্তির টাকা নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তায় আছি।’
রাজিয়া বেগম মেয়ের ভালো ফলে খুব খুশি। তিনি বলেন, ‘যে টেহা পাই, তা দিয়া ঠিকমতো সংসারই চলে না। তার মধ্যে স্বামীর ওষুধ ও মেয়ের লেখাপড়ার খরচ দিতে অয়। কোনো রহম ধারদেনা কইরা মেয়েডারে লেহাপড়া করাইছি। অহন কলেজে ভর্তি করাই লাগে। কিন্তু আতে তো টেহা না, মেয়েডার লেখাপড়ার খরচ লইয়া দুশ্চিন্তায় আছি।’
উত্তর নাকশী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘লাবনী সুযোগ পেলে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। কিন্তু মা–বাবা গরিব হওয়ায় লাবনীর কলেজে ভর্তি নিয়েই দুশ্চিন্তা রয়েছে।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন সাজেদুল আলম, রায়গঞ্জ, সিরাজগঞ্জ; আব্দুর রব, লালমনিরহাট; রহিদুল মিয়া, তারাগঞ্জ, রংপুর ও আবদুল মান্নান, নালিতাবাড়ী, শেরপুর]