‘দালালেরা দুই-তিনবার তারিখ দিয়েছে, কথা-কাজে মিল রাখেনি’
ছেলেকে মালয়েশিয়ায় পাঠাতে জমি বিক্রি করে দালালকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা দিয়েছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার দেবগ্রামের বাসিন্দা মেরাজ মিয়া। ছেলেকে সুপারশপের কাজ দিতে চেয়েছিলেন দালাল। সে জন্য জরুরি ভিত্তিতে ছেলের পাসপোর্টও তৈরি করেছিলেন। সাড়ে চার মাস আগে দালাল ফ্লাইটের তারিখ দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ফ্লাইট বাতিলের কথা জানান দালাল।
কয়েক দিন আগে ৩০ জনকে মালয়েশিয়ায় পাঠান দালাল। এতে মেরাজের পরিবারে বিশ্বাস জন্মায়, তাঁর ছেলেও বিদেশে যেতে পারবেন। দালালের কথামতো গত বৃহস্পতিবার ছেলে তানভির মিয়া ওরফে সোহেলকে (২২) নিয়ে ঢাকায় যান মেরাজ মিয়া। কিন্তু এবারও ফ্লাইট বাতিল হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে ছেলেকে নিয়ে ট্রেনে বাড়িতে ফিরছিলেন তিনি। পথে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ট্রেন থেকে পড়ে মেঘনা নদীতে নিখোঁজ হন ছেলে। এর পর থেকে ছেলের সন্ধানে পাগলের মতো ছুটছেন মেরাজ মিয়া।
গত শুক্রবার বিকেলে আন্তনগর ‘উপকূল এক্সপ্রেস’ ট্রেনে বাড়িতে ফেরার পথে ট্রেনের দরজা থেকে মেঘনা নদীতে পড়ে নিখোঁজ হন তানভির। এর পর থেকে ভৈরব নৌ থানা-পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছিলেন। আজ দুপুরে উদ্ধারকাজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উদ্ধারকর্মীদের ধারণা, ট্রেন থেকে পড়ে পানিতে ডুবে তানভিরের মৃত্যু হয়েছে। তাঁরা এখন লাশ ভেসে ওঠার অপেক্ষা করছেন।
তানভির মা–বাবার একমাত্র ছেলে। তাঁর বোন মাহবুবার বিয়ে হয়েছে দুই থেকে আড়াই বছর আগে। দুই দিন ধরে নিখোঁজ ছেলের জন্য একটু পরপর মূর্ছা যাচ্ছেন মা শারমিন আক্তার। বাড়িতে যিনি যাচ্ছেন, তাঁর কাছে ছেলেকে ফিরিয়ে এনে দেওয়ার মিনতি করছেন। পরিবারের সবাই তানভিরের লাশ ফিরে পাওয়ার দাবি জানান।
আজ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দেবগ্রামে গিয়ে সবার মুখে মুখে তানভিরের কথা শোনা গেল। তানভিরদের বাড়ির সামনে ‘আল্লাহর দান’ নামে মেরাজ মিয়ার একটি মুদিদোকান আছে। দোকানটি বৃহস্পতিবার থেকে বন্ধ। ওই দিনই সকালে ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন তিনি। তানভিরদের বাড়িতে ঢুকে পিনপতন নীরবতা দেখা গেল। বাড়ির দোতলায় থাকেন তানভিরের মা শারমিন আক্তার। ঘরে ঢুকতেই ছেলেকে এনে দিতে মিনতি করেন। একপর্যায়ে মূর্ছা যান তিনি। স্বজনেরা তাঁকে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে শান্ত করেন।
বাড়িতেই তানভিরের মামা ইমরান হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আখাউড়ার নয়াদিল গ্রামের দালাল আলমগীর হোসেন ও তাঁর মালয়েশিয়াপ্রবাসী ভাইয়ের মাধ্যমে তানভিরকে প্রবাসে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছিল। এ জন্য এক বছর আগে সাড়ে ছয় লাখ টাকা দেওয়া হয়। সাড়ে চার মাস আগে জানুয়ারির ১৯ তারিখে একবার ফ্লাইটের তারিখ দিয়েছিলেন আলমগীর। কিন্তু তখন ফ্লাইট বাতিল হয়।
ইমরান হোসেন বলেন, ‘ছেলেকে প্রবাসে পাঠাতে ও নিজের ব্যবসার জন্য ১৩০ শতক জমি বিক্রি করেন ভগ্নিপতি। তিন দিন আগেও ওই দালাল ৩০ জনকে নিয়ে গেছেন। তাই বিশ্বাস ছিল ভাগনেকে তাঁরা নিয়ে যাবেন। কারণ, ভাগনের সঙ্গে আরও অনেকের যাওয়ার কথা ছিল। শুক্রবার সকালে বা দুপুরে ফ্লাইট হওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে ফ্লাইট বাতিলের কথা জানানো হয়। শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে বেলা সাড়ে তিনটায় উপকূল ট্রেনে আখাউড়ার উদ্দেশে রওনা হয়। ভাগনের সঙ্গে তাঁর বাবা ও খালু উপস্থিত ছিলেন। ট্রেন ভৈরব অতিক্রম করার পর আসন থেকে ওঠেন তানভির। তাঁর খালু কারণ জানতে চাইলে টয়লেটে যাওয়ার কথা বলেছিলেন।
ইমরান আরও বলেন, ‘বগির দরজায় বসে ছিল। ট্রেনে নাকি তখন অনেক ভিড় ছিল। কিন্তু ভৈরব রেলসেতুতে থাকা অবস্থায় ট্রেনের লোকজন বলাবলি শুরু করেন, ট্রেন থেকে কেউ পড়ে গেছে। এরপর দুই ভগ্নিপতি আশুগঞ্জে নেমে নৌকায় করে ভৈরবে যান। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ভাগনের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এখনো খোঁজাখুঁজি চলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দালাল আলমগীর খুনি। তাদের নয়ছয় কথার কারণে ভাগনেকে হারাতে হয়েছে। দালালেরা দুই-তিনবার তারিখ দিয়েছে। তারা কথা-কাজে মিল রাখেনি।’
অভিযোগের বিষয়ে দালাল আলমগীর হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
তানভিরের মা শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুক্রবার দুপুরে ছেলে আমাকে ফোন করে জানায়, ফ্লাইট মিস হয়েছে। বাড়ি আসতেছে। আমি ছেলের জন্য বাজার থেকে লিচু কিনে আনি। বাড়িতে ছেলের পছন্দের মুরগি ও গরুর মাংস রান্না করি। এসব ছেলে ভীষণ পছন্দ করত। একমাত্র ছেলের সঙ্গে এমন হবে, কে জানত?’ একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।