যাদুকাটা বালুমহালে ‘চাঁদাবাজি’ বন্ধের দাবি, নিয়ন্ত্রণ নিতে চান বিএনপির নেতা-কর্মীরা

সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে যাদুকাটা নদের বালুমহালে চাঁদাবাজি ও নদের পাড় কেটে বালু তোলা বন্ধের দাবিতে ছাত্র-জনতার সমাবেশ। গতকাল সোমবার বিকেলে উপজেলার আনোয়ারপুর এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় যাদুকাটা বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। একজনের নামে এটি ইজারা নেওয়া হলেও এত দিন মূলত নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে যাদুকাটার নিয়ন্ত্রণ নিতে নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে একটি পক্ষ। ওই দিন বিকেলেই টোল আদায়ে বাধা দেওয়া হয়।

এর পর থেকে ইজারাদারের লোকজনও নানাভাবে বিষয়টি নিয়ে ওই পক্ষের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু এখনো সমঝোতা হয়নি। ইজারাদারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ছাত্র-জনতার নাম নিয়ে কিছু লোক কথা বললেও তলে তলে বিএনপির একটি পক্ষ বিষয়টি নিয়ে ‘সমন্বয়’ করার জন্য চাপ দিচ্ছে। তাঁরা মূলত ‘ভাগ’ চান।

তবে বিএনপির নেতারা বলছেন, এখানে টোল আদায়ের নামে ব্যাপক চাঁদাবাজি ও লুটপাট হচ্ছে। চাঁদাবাজি বন্ধ, এলাকার প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার দাবি তাঁদের। সরকার নির্ধারিত হারে টোল নেওয়ার কথা বলছেন তাঁরা।

ওই দাবিতে গতকাল সোমবার বিকেলে তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদের আনোয়ারপুর এলাকায় ‘ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে সমাবেশ হয়েছে। এর আগে শনিবার তাহিরপুর উপজেলা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে টোল আদায় ও অবাধে বালু উত্তোলন বন্ধের দাবি এবং ইজারা প্রদানে অনিয়মের অভিযোগ এনে অন্তর্বর্তী সরকারের তিনজন উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।

স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, এখান থেকে প্রতিদিন অবৈধভাবে কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। নদী থেকে ড্রেজারে এবং নদীর পাড় কেটে অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। ইজারা সীমানার বাইরে থেকে তোলা হচ্ছে বালু।

যাদুকাটা নদের দুটি বালুমহাল এবার প্রায় ৪৪ কোটি টাকায় ইজারা হয়েছে। অথচ গত বছরের ইজারামূল্য ছিল প্রায় ৬৯ কোটি টাকা। এবার যাদুকাটায় বেনামে যুক্ত হন সুনামগঞ্জ-১ আসনের (তাহিরপুর, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ, মধ্যনগর) সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য রনজিত চন্দ্র সরকারসহ সুনামগঞ্জ জেলা ও তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শনিবার থেকে নদীর পাড় কেটে বালু উত্তোলন বন্ধে স্থানীয় কয়েকটি গ্রামের মানুষ রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন। স্থানীয় ঘাগটিয়া গ্রামের বাসিন্দা পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী তানভীর আহমদ বলেন, ‘এলাকার মানুষ তাঁদের গ্রাম ও ভিটেমাটি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। নদীর পাড় কেটে আর বালু উত্তোলন করতে দেওয়া হবে না।’

স্থানীয় প্রশাসন, ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেছে, যাদুকাটা নদের দুটি বালুমহাল এবার প্রায় ৪৪ কোটি টাকায় ইজারা হয়েছে। অথচ গত বছরের ইজারামূল্য ছিল প্রায় ৬৯ কোটি টাকা। এবার যাদুকাটায় বেনামে যুক্ত হন সুনামগঞ্জ-১ আসনের (তাহিরপুর, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ, মধ্যনগর) সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য রনজিত চন্দ্র সরকারসহ সুনামগঞ্জ জেলা ও তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা। তাঁরাই প্রশাসনের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ইজারাতেই সরকারের প্রায় ১৫ কোটি টাকা কমিয়ে দেন। প্রশাসন এ বিষয়ে ছিল উদাসীন। এরপর নদীতে শত শত অবৈধ ড্রেজারে অবাধে বালু উত্তোলন করা হলেও প্রশাসন ও পুলিশ কার্যত নীরব থেকেছে।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিকেলেই টোল আদায় নিয়ে সেখানে বিপত্তি বাধে। টোল আদায়ের নামে এখানে চাঁদাবাজি হচ্ছে দাবি করে ইজারাদারের লোকজনকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এর এক দিন পর ৭ আগস্ট ইজারাদারের পক্ষের লোকজন নদের মিয়ারচর এলাকায় অবস্থান নেন। এখন ছাত্র-জনতার পক্ষের লোকজন অবস্থান নিয়েছেন আনোয়ারপুর এলাকায়। তাঁরা বালুবোঝাই নৌকা ও বাল্কহেড যেতে বাধা দিচ্ছেন।

বর্তমান ইজারাদারের একজন নদীতীরের ঘাগটিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মুজিবুর রহমান বলেন, তাঁরা প্রতি ঘনফুট বালুর জন্য টোল নিচ্ছেন ১৫ টাকা। সীমানার বাইরে, ড্রেজার বা নদীর পাড় কেটে বালু তোলা হচ্ছে না। তাঁর অভিযোগ, ৫ আগস্টের পর যাঁরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁদের টোল আদায়ে বাধা দিয়েছেন তাঁরা বিএনপির লোক। এখনো নানাভাবে বাধা দেওয়া হচ্ছে। নৌকা ও বাল্কহেড আটকে দেওয়া হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

পরিস্থিতির সুযোগে সেখানে টোল আদায় নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি স্থানীয় কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী, জেলা প্রশাসক, সুনামগঞ্জ

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সরকার নির্ধারিত হারে টোল আদায় করতে বলছেন। ৫ টাকা ২৫ পয়সার স্থলে নেওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। এখানে চাঁদাবাজি, লুটপাট চলছে। ইজারাদারের লোকজনের অত্যাচার–নির্যাতনে ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা অতিষ্ট।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেছেন, পরিস্থিতির সুযোগে সেখানে টোল আদায় নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি স্থানীয় কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।