প্রথম বাণিজ্যিক চা-বাগান সিলেটের মালনীছড়া
চা-বাগানটির আয়তন ২ হাজার ৫০০ একর। বাগানে ১ হাজার ৩০০ জন স্থায়ী ও ১ হাজার অস্থায়ী চা-শ্রমিক রয়েছেন।
চা-বাগান মানেই তো সবুজের চাদর বিছানো উঁচু-নিচু টিলায় দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দৃশ্য। সিলেট শহরতলির বিমানবন্দর সড়কের পাশে অবস্থিত মালনীছড়া চা-বাগানও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে প্রাচীনত্বের দিক থেকে মালনীছড়ার ঐতিহ্য বেশ পুরোনো। এটি কেবল সিলেটের প্রথম চা-বাগানই নয়, বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা-বাগানও।
বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, মতভেদ থাকলেও অনেক গবেষকের মতে, চট্টগ্রামের কোদালা চা-বাগানই দেশের প্রথম চা-বাগান। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪৩ সালে। তবে ১৮৫৪ সালে দেশে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়া চা-বাগান হচ্ছে মালনীছড়া। অবশ্য কোনো কোনো গবেষকের দাবি, বাগানটি ১৮৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সিলেটের এই চা-বাগানের মাধ্যমেই চা–চাষের গোড়াপত্তন। ইংরেজ ভদ্রলোক লর্ড হার্ডসন বাগানটি প্রতিষ্ঠা করেন।
বাগানের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ রাগীব আলীর ইচ্ছানুসারে কোনো জায়গায়ই অনাবাদি হিসেবে ফেলে রাখা হয়নি। বাগানের যে অংশ চা–চাষের অনুপযোগী, সেখানে নানা ধরনের ফলদ ও বনজ গাছের চারা তিনি রোপণ করেছেন।
তবে সিলেটের প্রয়াত চা-কর ও সাংবাদিক আমীনূর রশীদ চৌধূরী ১৯৭৬ সালে ‘সিলেটের চা-শিল্প’ শীর্ষক এক লেখায় জানিয়েছেন, ১৮৫৫ সালে সিলেট জেলায় চায়ের গাছ আবিষ্কার করার পরই মালনীছড়ায় চা-বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে নগরের টিলাগড়ের এখনকার মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের স্থানটিতে সিলেটের প্রথম চা-বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেও আরেকটি প্রচলিত মতামত তিনি লেখায় উপস্থাপন করেন।
যদিও গবেষক আবুল কাসেম বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত তাঁর চা: শিল্প ও সাহিত্য (২০১৬) বইয়ে মালনীছড়া সম্পর্কে জানিয়েছেন, চা বোর্ডের রেকর্ডপত্রে বাগানের প্রতিষ্ঠাকাল বলা হয়েছে ১৮৫৬ সাল। ইজারার তারিখ বলা হয়েছে ১৮৫৬ সালের ১৪ আগস্ট। ইজারায় ডিড স্বাক্ষর করেন সরকারের পক্ষে রেভিনিউ কমিশনার এবং কোম্পানির পক্ষে মি. ডব্লিউ উইনটন। ইজারাটি ছিল চিরস্থায়ী। ৩০ বছর পর নবায়নযোগ্য। কোম্পানি বাগানটি ১৮৯৪ সালে অধিগ্রহণ করে।
মালনীছড়া বাগান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মালনীছড়া চা-বাগান চালুর পর এর পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহু ইংরেজ, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি ব্যবস্থাপক। ১৯৮৭ সাল থেকে এটি সিলেটের বিশিষ্ট চা-কর ও শিক্ষানুরাগী সৈয়দ রাগীব আলীর ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। চা-বাগানটির মোট আয়তন ২ হাজার ৫০০ একর। এর মধ্যে ৭০০ একর জায়গায় রবার ও ৭ একর জায়গায় কমলা উৎপাদন করা হয়। বাগানে ১ হাজার ৩০০ জন স্থায়ী ও ১ হাজার অস্থায়ী চা-শ্রমিক রয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সিলেটের দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয় চা-বাগানগুলোর মধ্যে মালনীছড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সকাল-বিকেল বাগানে রংবেরঙের চেনা-অচেনা পাখি উড়ে বেড়ায়। এ বাগানের উঁচু-নিচু টিলায় চা-বাগান আর সারি সারি গাছের সমাহার দেখতে প্রায় প্রতিদিনই দল বেঁধে দেশের নানা অঞ্চলের পর্যটকেরা ভিড় জমান। পর্যটকদের কেউ কেউ বাগান কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢোকেন, আবার কেউ কেউ বাগানের বাইরে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করেন। বিশেষত ছুটির দিনগুলোয় বিকেলের দিকে হাজারো মানুষকে চা-বাগানে বেড়াতে আসতে দেখা যায়।
বাগানের ব্যবস্থাপক মো. আজম আলী জানান, বাগানের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ রাগীব আলীর ইচ্ছানুসারে কোনো জায়গায়ই অনাবাদি হিসেবে ফেলে রাখা হয়নি। বাগানের যে অংশ চা–চাষের অনুপযোগী, সেখানে নানা ধরনের ফলদ ও বনজ গাছের চারা তিনি রোপণ করেছেন। এখানে এক লাখের বেশি কাঁঠালগাছই রয়েছে। এর বাইরে দারুচিনি, গোলমরিচ, জলপাই, হরীতকী, আমলকী, অর্জুন, জাম, আম, লটকন, বেলসহ নানা প্রজাতির গাছ রয়েছে। গাছের ফল চা-শ্রমিকদের খাওয়ার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।