বন্যা-বৃষ্টির চাপ নিতে পারছে না সিলেট

পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছে। বুধবার দুপুরে কলাপাড়া এলাকায়ছবি: আনিস মাহমুদ

রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে। কারও কারও ঘরে কোমর থেকে বুকসমান পানি। ডুবেছে খেতের ফসল, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। প্লাবিত হয়েছে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। ঘরে মাচা বেঁধে কিংবা উঁচু স্থানে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন। পানিবন্দী এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার ও সুপেয় পানির সংকট। বিপদ আরও বাড়াচ্ছে টানা বৃষ্টি। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।

এবার বর্ষা মৌসুম শুরু হতে না হতেই দ্বিতীয়বারের মতো বন্যার পানিতে ডুবল সিলেট। গত সোমবার শুরু হওয়া বন্যার পানিতে জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ তলিয়ে গেছে।

আবহাওয়াবিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদেরা বলছেন, বন্যা ও বৃষ্টির পানির চাপ কোনোক্রমেই নিতে পারছে না সিলেট। সুরমা ও কুশিয়ারা নদী খননের কাজ না হওয়ায় এবং জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশনের ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকার প্রকল্প কাজে না আসায় অল্প বৃষ্টি ও উজানের ঢলে নগরসহ তলিয়ে যাচ্ছে জেলার বেশির ভাগ এলাকা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে গত দেড় দশকে হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। সুরমা নদী খননেও অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে গত দুই বছরে। এসব প্রকল্পের কাজ যথাযথভাবে হয়নি। তাই সামান্য বৃষ্টিতেই সিলেট পানির চাপ সহ্য করতে পারছে না। এর মধ্যে ভারী বৃষ্টিতে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। এ অবস্থায় সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা, কুশিয়ারাসহ সব কটি নদ-নদী খনন করা প্রয়োজন।

সিলেটে ঘন ঘন বন্যা হওয়ার কারণ সম্পর্কে আবদুল করিম চৌধুরী বলেন, অপরিকল্পিতভাবে হাওরে উন্নয়নকাজ হচ্ছে, নদীতে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে। এসব বন্ধ করা প্রয়োজন।

এর আগে গত ২৯ মে ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে সিলেটে বন্যা দেখা দেয়। ৮ জুনের পর থেকে বন্যা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। সর্বশেষ সোমবার শুরু হওয়া অবিরাম বৃষ্টিতে আবার জেলায় বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এর আগে ২০২২ সালের মে মাসে ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিতে নগরে বন্যা দেখা দেয়।

১ / ১০
কোমরসমান পানি মাড়িয়ে চলেছেন একজন। গোয়াইনঘাট উপজেলার রানীগঞ্জ গ্রামে।

প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন

নদী ও ছড়া (প্রাকৃতিক খাল) পরিকল্পিতভাবে আরও সুগভীর করার পাশাপাশি অবৈধ দখলমুক্ত করে খনন করা হলে নগরের বন্যা পরিস্থিতি এতটা অবনতি হতো না বলে মনে করেন নগরের বাসিন্দারা। নগর দিয়ে প্রবাহিত ছড়া ও খালগুলো যথাযথ খননের অভাবে পানির ধারণক্ষমতা হারিয়েছে।

সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা জানিয়েছে, ২০০৯ সালের পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ছড়া খনন, ছড়ার পারে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে রিটেনিং ওয়াল নির্মাণ, ইউটাইপ ড্রেন ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ, নালানর্দমা প্রশস্তকরণসহ জলাবদ্ধতা নিরসন-সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সিটি করপোরেশন। চলতি বছর একই খাতে সাড়ে ৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ডে আরও প্রায় ৫৫ কোটি টাকার কাজ চলছে।

এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সুরমা নদী পানিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকায় নগর দিয়ে প্রবাহিত ছড়া ও খালের পানি নামতে পারছে না।

স্রোতে ভেসে একজনের মৃত্যু

বন্যায় সিলেট জেলার কমবেশি ১৩টি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে গতকাল বুধবার সকাল নয়টার দিকে আবদুল হালিম (৫৫) নামের এক ব্যক্তি স্রোতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ হন। পরে বেলা দুইটায় তাঁর মরদেহ পানিতে ভেসে উঠলে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে। নিহত হালিমের বাড়ি জকিগঞ্জ উপজেলার মুহিদপুর গ্রামে।

বন্যাকবলিত এলাকার লোকজন বলছেন, সিলেট নগরের ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৩টি ওয়ার্ডের শতাধিক এলাকায় বন্যার পানি ঢুকেছে। নগর ও জেলায় কয়েক হাজার দোকানের পাশাপাশি ১৫ থেকে ২০ হাজার বাসাবাড়িতে পানি ঢুকেছে। অনেক কাঁচা ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য বলছে, সিলেটের সব কটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। প্রধান দুই নদী সুরমা, কুশিয়ারাসহ তিনটি নদীর পানি ছয়টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সুরমা নদীর পানি উপচে প্লাবিত সিলেট নগরের মেন্দিবাগ এলাকা। বুধবার দুপুরে তোলা ছবি
আনিস মাহমুদ

জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান গতকাল বিকেলে বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। প্রচুর ত্রাণ মজুত থাকলেও জলযানের সংকটে পৌঁছাতে সমস্যা হচ্ছে। তবে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সবখানেই ত্রাণ ও বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

গতকাল সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সিলেট নগরের বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উপশহর, যতরপুর, তালতলা, জামতলা, ছড়ারপাড়, কামালগড়, মাছিমপুর, ঘাসিটুলা, শামীমাবাদ এলাকাসহ নিচু এলাকার অনেক বাসিন্দা ঘর ছেড়ে পরিচিতজন কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রের উদ্দেশে যাচ্ছে। অনেকে ঘরে কয়েক স্তরে ইট ফেলে সেখানে খাট তুলে কোনোরকমে আছে।

সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যবেক্ষণ করছেন এবং নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান। গতকাল বেলা তিনটার দিকে নগরের মীরাবাজার এলাকার কিশোরী মোহন (বালক) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যার্তদের ত্রাণসহায়তা দিতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেন।

খাবারের কষ্টে মানুষ

নগরের মীরাবাজার এলাকার কিশোরী মোহন (বালক) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালু হওয়া আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবারের চার সদস্যকে নিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন মজিদা বেগম (৫০)। যতরপুর এলাকার এই বাসিন্দা গতকাল সকাল ১০টার দিকে বলেন, তাঁর ঘরে বুকসমান পানি। ঘরের আসবাবসহ সবই এখন পানির নিচে। ঈদের দিন থেকে তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিলেও একবার মাত্র চিড়া-মুড়ি পেয়েছেন। খাবারের কষ্টে আছেন তাঁরা।

শুধু মজিদা বেগমই নন, জেলার অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া অনেকে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির কষ্টে ভুগছেন বলে অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া বন্যাকবলিত একাধিক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার ও পানি কিছুটা পাওয়া গেলেও বানভাসি অনেকে কোনো ধরনের খাবার সহযোগিতা পাচ্ছেন না। খাবারের জন্য শিশুরা কান্নাকাটি করছে। ঘুম ও খাবারের অভাবে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চত্বরে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। হাসপাতাল তিনটির চত্বরে গোড়ালি থেকে হাঁটুসমান পানি উঠেছে। এতে রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা ভোগান্তিতে পড়েছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, জেলায় মাঠে ফসল রয়েছে ২০ হাজার ৩৮৪ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে প্লাবিত হয়েছে ১১ হাজার ৭০৭ হেক্টর। জেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৪১৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং প্রায় ৫০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় পানি ঢুকেছে। এতে বিদ্যালয়ের মেঝে ও আসবাব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।