প্রায় ২০ বছর ধরে বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া দোকান চালান হেকমত আলী (৬০)। একটা সময় খড়ের ঘরে কুপি জ্বালিয়ে দোকান চালাতেন। ছিটমহলের বাসিন্দা থাকা অবস্থায় নিজের দুই ছেলে ও এক মেয়ে কাউকে লেখাপড়া করাতে পারেননি। ছিটমহল বিলুপ্ত হওয়ার পর এখন বাড়ির সামনেই মাদ্রাসায় তাঁর নাতি-নাতনিরা পড়াশোনা করছে। ছিটমহল বিনিময়ের ৯ বছরে দিনও বদলে গেছে তাঁদের।
বুধবার দুপুরে পঞ্চগড় সদর উপজেলার বিলুপ্ত হওয়া গাড়াতি ছিটমহলের রাজমহল এলাকায় বাড়িসংলগ্ন মুদিদোকানে বসে কথা হয় হেকমত আলীর সঙ্গে। বিলুপ্ত ছিটমহলে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। হেকমত আলী বলেন, ‘এই দেহেন আমার দোকানে এহন ফ্রিজ রাখছি। এইটা আমরা কোনো দিন কল্পনাই করতে পারি নাই।’
হেকমত আলী আরও বলেন, ‘একটা সময় বাড়ির চাইরদিকে জঙ্গল আছিলো, বইশ্যালীর (বর্ষার) সময় যে রাস্তায় পানি জইমা থাকত, হেই রাস্তা এখন পাকা হইচে, কারেন্ট পাইছি। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার সুযোগ পাইছে। কোনো সমস্যা হইলে প্রশাসনের কাছে যাইতে পারি। সব মিলায়া ভালাই আছি। আমাগোর কল্পনার চেয়ে বেশি পরিবর্তন হইচে।’
দীর্ঘ ৬৮ বছর অপেক্ষার পর ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশে ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় হয়। এরপর এখানকার জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নানা কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি বিভিন্ন সুবিধা পেতে থাকেন এখানকার লোকজন। সেই সঙ্গে হয়েছে নানা উন্নয়ন ও অবকাঠামো।
বুধবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত পঞ্চগড়ের বিভিন্ন বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো ঘুরে দেখা যায়, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। পাকা হয়েছে রাস্তা। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন স্কুল ও কলেজ। প্রতিটি পরিবার ব্যবহার করছে স্যানিটারি ল্যাট্রিন ও নলকূপ। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় আছে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার সুযোগ। হতদরিদ্র কিছু পরিবারকে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে সেমিপাকা ঘর। গড়ে উঠেছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। সেই সঙ্গে বাসিন্দারা পেয়েছেন জমির মালিকানা।
১৯৭৪ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তি (মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি) বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশে ও ভারতের মধ্যে বিনিময় হয় ১৬২টি ছিটমহলের। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ড এবং ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের ভূখণ্ড হয়ে যায়। পরের দিন ১ আগস্ট সকাল ৬টায় জেলার অভ্যন্তরে থাকা প্রতিটি বিলুপ্ত ছিটমহলে আনুষ্ঠানিকভাবে উড়ানো হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। এতে দুই দেশেরই মানচিত্র পায় পূর্ণতা। আর ছিটমহলবাসী পান দীর্ঘ ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি। অবসান ঘটে দীর্ঘ বছরের বঞ্চনা ও মানবিক সমস্যার।
বুধবার দুপুরে বাড়ির পাশের ডোবায় জাগ দেওয়া পাট থেকে আঁশ আলাদা করার কাজ করছিলেন কৃষক আনারুল ইসলাম (৪৫)। ছিটমহল বিনিময়ের পর পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বেশ উচ্ছ্বসিত। তিনি বলেন, এখন বাড়ির সামনে পাকা রাস্তায় উঠে একেবারে বাজারে গিয়ে নামেন। বাজারে যেতে আর কাঁচার রাস্তায় নামতে হয় না।
আনারুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ভাই, বিশ্বাস করেন, আমি ছিটমহলের বাসিন্দা হওয়ায় আমার বিয়ের কোনো কাবিন হয়নি। আমার বড় মেয়েকে পড়াশোনা করাতে পারিনি। এমনকি টিকাও দিতে পারিনি। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে একবার বাংলাদেশের একটা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করেছিলাম বড় মেয়েকে। সেখানে আমার মেয়ে ছিটমহলের বাসিন্দা হওয়ায় সে বিস্কুটের প্যাকেটটা পর্যন্ত পায়নি। আর এখন ছোট এক ছেলে ও এক মেয়ে বাড়ির পাশেই স্কুলে পড়ছে। এর চেয়ে আর সুখের কী আছে বলেন?’
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলার সাবেক সভাপতি মফিজার রহমান বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের ৯ বছর পূর্ণ হলো। ছিটমহল বিনিময়ের কারণে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের কাছে তাঁরা চিরকৃতজ্ঞ। দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে ‘ছিটমহল স্বাধীনতা’ অথবা ‘বিনিময় দিবস’ হিসেবে জাতীয় স্বীকৃতির দাবি জানাচ্ছেন।