নদীর পাড়ে নবান্ন উৎসব

ইস্পাহানির ব্র্যান্ড ‘পার্বণ’-এর উদ্যোগে ও প্রথম আলো ডটকমের আয়োজনে মানিকগঞ্জের কালীগঙ্গা নদীর পাড়ে দিনভর অনুষ্ঠিত হলো নবান্ন উৎসব। অনুষ্ঠানে ধাঁধার আসরে দর্শকদের প্রশ্নের উত্তর দেন অভিনেতা মীর সাব্বির। গতকাল বিকেলেছবি: দীপু মালাকার

কালীগঙ্গা নদীতে তেমন স্রোত নেই। পানির ধারাও ক্ষীণ। শীতের ঠান্ডা হাওয়া ছুটে আসছে নদীর বুক ছুঁয়ে। পূর্ব পাড়ে শর্ষেখেতের হলুদ বিস্তার। পশ্চিম পাশের ঢালু পাড়ে ভুট্টা, তামাক ও শীতের হরেক রকম সবজির আবাদ। নদীর পাড় থেকে ভেসে যাচ্ছে জারিগানের মেঠো সুর ‘শুনিলে সাঁই বারামখানা…’।

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের সাইংজুরী গ্রামের ভেতর দিয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তরে বয়ে গেছে এই কালীগঙ্গা নদী। গতকাল বৃহস্পতিবার পৌষের শীতের সকালে এখানে জারি, সারি, লালন, গাজীর গান আর পায়েস-পিঠাপুলির আয়োজন নিয়ে শুরু হয়েছে ‘ইস্পাহানি পার্বণ নবান্ন উৎসব’। সারা দিনের এই আয়োজন করেছে প্রথম আলো ডট কম। এই আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল ইস্পাহানির পার্বণ।

বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান লোকসংগীতের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য রয়েছে মানিকগঞ্জের। পাশাপাশি মানিকগঞ্জের পিঠাপুলিরও রয়েছে বিশেষ প্রসিদ্ধি। এই ঐতিহ্যকে স্মরণ করে একেবারে প্রাকৃতিক পরিবেশে এখানে দেশের অন্যতম ঋতুভিত্তিক নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে।

নদীর কিনার থেকেই সারি সারি চেয়ার পাতা। পাড়ের খানিকটা ওপরে পূর্ব দিকে মুখ করা মঞ্চ। উত্তর পাশে কৃষি ও স্থানীয় কারুপণ্যের পসরা। স্টলগুলোতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে খেত থেকে তুলে আনা টাটকা শালগম, গাজর, কপি, শিমসহ হরেক রকম মৌসুমি সবজি। কৃষকেরাও এসেছিলেন লাঙল-জোয়াল নিয়ে। এর পরের স্টলগুলোতে আছে বাঁশ–বেতের সামগ্রী, মাটির হাঁড়ি–পাতিল, হরেক রকম পুতুল এসব। আর দক্ষিণে বসেছে খাজা, গজা, বাতাসা, চিনির ছাঁচ, মোয়া-মুড়িসহ হরেক রকম গ্রামীণ মিঠাইয়ের পসরা। তার পাশেই আছে নাগরদোলা।

অনুষ্ঠানে আয়োজন ছিল পিঠাপুলির। গতকাল দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

ইস্পাহানির ব্র্যান্ড ‘পার্বণ চাল’ দিয়ে হরেক রকমের পিঠা আর পায়েস তৈরি হচ্ছে মঞ্চের পাশের ছাউনিতে। বাতাস বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তার সুবাস। দর্শক আর অতিথিদের জন্য শীতের সকালে পিঠাপুলির সঙ্গে ছিল ইস্পাহানির ধোঁয়া ওঠা গরম চা।

সকালে উৎসবের উদ্বোধন করেন ঘিওর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ইসতিয়াক আহম্মেদ। তিনি বলেন, ‘মানিকগঞ্জ কৃষিনির্ভর এলাকা। কৃষি ছাড়াও এই এলাকার লোকসংগীত ও পিঠার সারা দেশে সুনাম রয়েছে। প্রথমবারের মতো এই গ্রামীণ পরিবেশে নবান্ন উৎসব করায় আমরা খুব আনন্দিত।’

ইস্পাহানি লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক ফজলে রাব্বি বলেন, ‘এখন ধান কাটা প্রায় শেষ। এই সময় সারা দেশেই বহু প্রাচীনকাল থেকে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। আমরা এই আয়োজনের মাধ্যমে মানুষের ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসবে যুক্ত হতে চাই। মানুষের হৃদয়ে স্থান পেতে চাই।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরে আওলাদ গায়েন ও তাঁর দল পরিবেশন করে গাজীর গান। এর পরে খন্দকার উজ্জ্বলের পরিচালনায় বৈঠকি জারিগান নিয়ে মঞ্চে আসেন আবদুল মান্নান বয়াতি। এভাবেই গানে গানে বেলা উঠে যায় মধ্যগগনে।

বিকেলের আয়োজন

বিকেলে মৌসুমী মৌয়ের সঞ্চালনায় শুরু হয় জমজমাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নদীর পশ্চিম পাড়ে তখন শিশু, নারী–পুরুষের বিপুল সমাগম। নদীর পূর্ব পাড়ের স্বরূপঘাটা, আশাপুর, লাকিববাড়ি গ্রাম থেকে সেজেগুজে লোকজন আসছিলেন নদীর পাড়ে। নৌকায় পার হয়ে এ পাড়ে এসে মেতে উঠেছিলেন উৎসবে। প্রথমেই ছিল স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান শাওন মজুমদারের সরস পরিবেশনা।

এরপর মঞ্চে লাঙল-জোয়াল নিয়ে ধুয়াগান গাইতে আসেন মানিকগঞ্জের কালাচাঁদ বয়াতি ও তাঁর দলের গাইয়েরা। তাঁরা মঞ্চে নেচে নেচে গাইছিলেন, ‘বুইড়া হইলে মাইয়া লোকে ভালোবাসে না’। তাঁরা তিনটি গান গেয়ে শোনান। এরপর মঞ্চে এলেন ষাটোর্ধ্ব আবদুল কুদ্দুছ। তিনি জানালেন, যে গানটি তিনি গাইবেন, তার নাম ‘চকের গান’। চক অর্থ ফসলের মাঠ। স্থানীয় কৃষকেরা ফসল কাটা, বোনাসহ মাঠে কাজের সময় এই গানগুলো গেয়ে থাকেন। তিনি দরাজ গলায় শুরু করলেন, ‘মন চাষা আমার জান নাকি, এই দেহ জমিন আবাদ হয় কিসে?’ দর্শকেরা হাততালি দিয়ে মাতিয়ে তুললেন আয়োজন।

এরপর শুরু হয়ে যায় প্রতিযোগিতার পালা। শিশুদের জন্য ছিল দুই পর্বে স্মৃতির পরীক্ষা, নারীদের জন্য ফুটবলে লাথি দিয়ে গর্তে ফেলা, পুরুষদের জন্য দড়ি–টানাটানি। আরও ছিল ধাঁধা। অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতা মীর সাব্বির ও মৌসুমী মৌ এই পর্বটি আনন্দঘন করে তোলেন। দর্শকদের অনুরোধে মীর সাব্বির বরিশালের টানে বলেন, ‘মানিকগঞ্জের সাইংজুরীতে আইয়া মোর জম্মের ভালো লাগছে।’

ইস্পাহানি অ্যাগ্রো লিমিটেডের পরিচালক ফৌজিয়া ইয়াসমিন বলেন, ‘এই নদীর পাড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে গ্রামবাসীকে নিয়ে নবান্ন উৎসব আয়োজন করতে পেরে আমাদের খুবই ভালো লাগছে। সামনেও আমাদের ঐতিহ্যবাহী এ ধরনের সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে।’

কথাসাহিত্যিক ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুল হক বলেন, সারা দিনে আজ অনেক আনন্দ হলো। শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মানিকগঞ্জের গৌরবময় ভূমিকা রয়েছে। অনেক গুণী মানুষের জন্ম হয়েছে এখানে। নতুন প্রজন্ম সেই উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে।

বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণের পর সারা দিনের এই আনন্দ আয়োজন শেষ হয়েছিল শিল্পী তাসিবার জনপ্রিয় গান ‘আইলা রে নয়া দামান’, ‘বসন্ত বাতাসে’ গানে গানে।