১৯২১ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো কুমিল্লায় এসেছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এরপর বিভিন্ন সময় তিনি কুমিল্লায় এসেছেন। এখানে বসেই সৃষ্টিশীল নানা গান, কবিতা লিখেছেন। জড়িয়েছেন প্রেমে। কবির রাজনৈতিক জীবনেও কুমিল্লা জড়িয়ে ছিল। তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা লিখে কুমিল্লাতেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এভাবেই কুমিল্লার সঙ্গে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল জাতীয় কবির।
আজ ২৫ মে। কবির ১২৪তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে কুমিল্লা শহর ও মুরাদনগরের দৌলতপুরে আয়োজন করা হয়েছে নানা অনুষ্ঠানের।
পাঁচ দফা কুমিল্লা সফরে কবি
পুস্তক প্রকাশক আলী আকবর খানের সঙ্গে ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম কুমিল্লা রেলস্টেশনে নামেন নজরুল। এরপর তিনি আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লা নগরের বীরেন সেনের বাসায় ছিলেন চার-পাঁচ দিন। সেখান থেকে মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুরে যান। সেখানে আলী আকবর খানের পুকুরে সাঁতার কেটে, পলো দিয়ে মাছ ধরে, জ্যোৎস্নারাতে পুকুরপাড়ের আমগাছের নিচে বাঁশি বাজিয়ে সময় কাটিয়েছেন কবি। সেখানেও কাব্য রচনা করেছেন। ১৮ জুন পর্যন্ত কবি দৌলতপুরে ছিলেন। এরপর ১৯ জুন থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত কুমিল্লা শহরে ছিলেন।
দ্বিতীয়বার ১৯২১ সালের নভেম্বরে কবি কুমিল্লায় আসেন। এরপর ডিসেম্বরে কলকাতায় চলে যান। তৃতীয়বার ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আসেন। এরপর জুন মাসে ফিরে যান। চতুর্থবার ১৯২২ সালের অক্টোবরে কুমিল্লায় আসেন। ২৩ নভেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাঁকে কলকাতায় পাঠানো হয়। পঞ্চমবার ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর কুমিল্লায় আসেন।
বিশিষ্ট নজরুল-গবেষক আলী হোসেন চৌধুরী বলেন, তরুণ ও টগবগে সময়ে কবি নজরুল কুমিল্লা ও দৌলতপুরে ছিলেন। তাঁর আবেগ ও উচ্ছ্বাস এখানে বিলিয়ে দিয়েছেন।
দৌলতপুরে কবির দিনলিপি
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুরে কবির আগমন উপলক্ষে তোরণ নির্মাণ করা হয়। তখন কবির ঝাঁকড়া চুল ছিল। সেখানে গিয়ে গ্রামের ছেলেদের গান শেখাতেন। মেয়েদের নাচ শিখিয়েছেন। কবি নিজে খাঁ বাড়ির পুকুরের শান্ত পানিতে গোসল করতেন। সাঁতার কাটতেন। এক ডুবে পুকুরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় চলে যেতেন। পলো দিয়ে মাছ ধরতেন। হারমোনিয়াম বাজাতেন।
দৌলতপুরে বসে কবি অসংখ্য কাব্য রচনা করেছেন। কবি দৌলতপুর ও কুমিল্লা নিয়ে বাংলা গান ও কবিতার চারটি বই প্রকাশ করেন। এগুলো হলো ‘দোলন চাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘পুবের হাওয়া’ ও ‘ঝিঙেফুল’। এ ছাড়া বাংলা ১৩৩৬ সনে ‘চক্রবাকে’ও দৌলতপুরের স্মৃতি নিয়ে কবিতা আছে।
দৌলতপুরে কবি নজরুলের সঙ্গে আলী আকবর খানের বড় বোন আসমাতুন নেসার মেয়ে সৈয়দা খাতুনের পরিচয় হয়। তখন নজরুলের বয়স ২২, সৈয়দা খাতুনের বয়স ১৬। কবি নজরুল সৈয়দা খাতুনের নাম দেন নার্গিস আসার খানম।
দৌলতপুরে কবি নজরুল মঞ্চ, মুরাদনগরের কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর সড়কের পাশে নজরুল তোরণ আছে। আলী আকবর খানের দ্বিতল বাড়িতে আছে নজরুলের ব্যবহৃত খাট।
প্রমীলার সঙ্গে বিয়ে
১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল কাজী নজরুল ইসলামের বিয়ে হয় কুমিল্লার মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তর সঙ্গে। তাঁর ডাকনাম ছিল দুলী। তবে কবি ডাকতেন প্রমীলা বলে। ভারতের কলকাতার ৬ নম্বর হাজি লেনে ওই বিয়ে হয়।
কুমিল্লা শহরে কবির যত স্মৃতিচিহ্ন
কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লা শহরের যেসব এলাকায় আড্ডা দিতেন, গল্প করতেন, থাকতেন, সেখানে নামফলক আছে। ১৯৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর নজরুল স্মৃতিরক্ষা পরিষদের উদ্যোগে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত স্থানে স্মৃতিফলক বসানো হয়। কুমিল্লা শহরের ঝাউতলা মসজিদের কাছে, ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শাখার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে (রানীর দিঘির পাড়ে), নজরুল অ্যাভিনিউ সড়কের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে, ফরিদা বিদ্যায়তনের সামনে, দারোগা বাড়ি, ঝানু মিয়ার বাড়ি, শচীন দেববর্মনের বাড়ি, বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার ও প্রমীলার বাড়ি এবং রাজগঞ্জ থানা এলাকায় স্মৃতিচিহ্ন আছে।
কুমিল্লায় নজরুলের নামে যত কিছু
১৯৬২ সালে কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় থেকে ধর্মপুর পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয় ‘নজরুল অ্যাভিনিউ’ নামে। ১৯৬৯-১৯৭০ সালে কুমিল্লা নজরুল পরিষদ প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৭২ সালে কুমিল্লা নগরের ধর্মসাগরের উত্তর পাড়ে নজরুল পরিষদের জন্য জায়গা চিহ্নিত করা হয়। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে কবি নজরুল ছাত্র হল আছে। ১৯৯১ সালে জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চেতনায় নজরুল স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ২০০৮ সালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজী নজরুল ইসলামের নামে ছাত্র হল প্রতিষ্ঠা হয়।
২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল কুমিল্লার ধর্মসাগরের উত্তর পাড়ে তিনতলাবিশিষ্ট নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুরাদনগরের দৌলতপুরে নজরুল নার্গিস উচ্চবিদ্যালয় আছে। মুরাদনগর উপজেলা কমপ্লেক্স মিলনায়তনের নাম রাখা হয় কবি নজরুলের নামে। এ ছাড়া নগরের নানুয়া দিঘীর দক্ষিণ পাড়ে রয়েছে শিশুদের স্কুল নজরুল একাডেমি। রয়েছে নজরুলের নামে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক সংগঠন।
বিশিষ্ট নজরুল-গবেষক অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে কুমিল্লায় নজরুলের সৃষ্টিকর্ম বেশি। কুমিল্লা ও দৌলতপুরে কবি অজস্র গান ও কবিতা রচনা করেছেন। নজরুলকে নিয়ে আরও গবেষণার সুযোগ আছে।
কুমিল্লায় তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি
কবির ১২৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আজ কুমিল্লায় তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সকাল সাড়ে ৯টায় চেতনায় নজরুল ম্যুরালে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে নজরুলের আলোকচিত্র ও পুস্তক প্রদর্শনী, ‘অগ্নিবীণার শতবর্ষ: বঙ্গবন্ধুর চেতনায় শাণিত রূপ’ প্রবন্ধের ওপর আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আগামীকাল দৌলতপুরে ও ২৭ মে বিকেলে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণ করা হবে।
১৮৯৯ সালের এই দিনে ভারতের আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট তিনি মারা যান।