মানিকগঞ্জে নতুন করে স্বপ্ন বুনছেন সবজিচাষিরা
মাসখানেক আগে পাঁচ বিঘা জমিতে শীতের আগাম সবজি ফুলকপির আবাদ করেছিলেন মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার ফকুরহাটি চরপাড়া গ্রামের চাষি শহিদুল ইসলাম (৪৫)। তবে অসময়ে বৃষ্টিতে সবজিখেতে পানি জমে সবজির চারা মরে যায়। এতে প্রায় দেড় লাখ টাকা লোকসানে পড়েন তিনি। পানি নেমে যাওয়ার পর নতুন করে সেই জমিতে আবার ফুলকপির চারা রোপণ করেছেন তিনি।
গতকাল সোমবার সকালে জমিতে পরিচর্যা করছিলেন শহিদুল। এ সময় কথা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে এ সময়ে এত বৃষ্টিপাত হয় নাই। এবারের বৃষ্টির পানি জমে খেতের সব ফুলকপির চারা নষ্ট হইয়্যা গ্যাছে। জমিতে হালচাষ, চারা কেনা, সার ও কামলা (শ্রমিক) খরচ বাবদ প্রায় দেড় লাখ ট্যাহা খরচ হইছিল। বৃষ্টিতে প্রায় চারাই নষ্ট হইয়্যা গ্যাছে। আবার লক্ষাধিক ট্যাকা খরচ কইরা নতুন কইরা কপির চারা লাগাইছি।’
শুধু শহিদুলই নন, তাঁর মতো সাটুরিয়ার ফকুরহাটি চরপাড়া গ্রামের শরীফুল ইসলাম এবং সদর উপজেলার চান্দির চর গ্রামের মেহের আলী, আলমগীর হোসেনসহ আরও অনেক চাষিই অসময়ের বৃষ্টিতে সবজির ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় লোকসানের মুখে পড়েন। তবে এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাষিরা আবার নতুন করে শীতের বিভিন্ন সবজি আবাদে এখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সাটুরিয়ার রাইল্যা, ফকুরহাটি, ফকুরহাটি চরপাড়া, জান্না ও জেলা সদরের চান্দির চর, দিয়ারা ও বাসুদেবপুর গ্রাম ঘুরে সবজিখেতে চাষিদের কর্মচাঞ্চল্য দেখা যায়। এসব গ্রামে চাষিদের কেউ জমিতে হালচাষ করছেন, কেউ সবজির চারা রোপণ করছেন; কেউ সবজিখেতে সার ও কীটনাশক দিচ্ছেন, আবার কেউ সবজিখেত পরিচর্যা করছেন। সবজি চাষই তাঁদের আয়ের উৎস।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক চাষি বলেন, সবজি চাষে জমির উর্বরতা বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের সার ও পোকামাকড় দমনে কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। তবে বাজারে এসব সারের দাম তুলনামূলক বেশি। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, বাজারে সার বিক্রির একজনমাত্র খুচরা বা পাইকার ডিলার রয়েছেন। এ কারণে দর–কষাকষির সুযোগ থাকে না। স্থানীয়ভাবে একাধিক খুচরা বিক্রেতা থাকলে সারের দাম নিয়ে দর–কষাকষির সুযোগ থাকত।
জেলার সিঙ্গাইর, সাটুরিয়া ও সদর উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন সবজির ব্যাপক আবাদ হয়ে থাকে। এ ছাড়া জেলার ঘিওর, শিবালয়, দৌলতপুর ও হরিরামপুরে সবজির আবাদ হলেও তা তুলনামূলক কম। এ জেলায় বেগুন, লাউ, মুলা, করলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বরবটি, শিম, আলু, পেঁপে, টমেটো, গাজর, পুঁইশাক, লালশাক, লাউশাক, কচু, চিচিঙ্গা, ঢ্যাঁড়স, চালকুমড়া, ওলকপি, মিষ্টিকুমড়া, কচুর আবাদ করে থাকেন চাষিরা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিঙ্গাইরের সবজি ঢাকার কারওয়ান বাজারসহ সাভার, গাজীপুরের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। জেলা সদর ও সাটুরিয়ার সবজি জেলা সদরে পাইকারি বাজারে বেশি পাঠানো হয়। ঢাকার কাঁচাবাজারেও সেখানে সবজি পাঠানো হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছর জেলায় ৯ হাজার ৩৮২ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন সবজির আবাদ করা হয়েছিল এবং উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪৬৩ মেট্রিক টন সবজি। এ বছরও একই পরিমাণ জমিতে সবজির আবাদ ও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও একই পরিমাণ নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। এ বছর এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৭৫৪ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন সবজির আবাদ করা হয়েছে। তবে এ বছর বৃষ্টিতে সবজির ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়নি।
সদর উপজেলার চান্দির চর গ্রামে ১৬ বিঘা জমিতে মুলার আবাদ করছেন চাষি মনির হোসেন। গতকাল সাত-আটজন কৃষিশ্রমিককে নিয়ে তিনি খেতে মুলার বীজ বপন করেন। তিনি বলেন, প্রবাসী এক ব্যক্তির কাছ থেকে ওই জমি ভাড়া নিয়ে তিনি মুলার আবাদ করছেন। বৃষ্টির কারণে বিলম্ব হলেও সবজি আবাদে তিনি লাভের প্রত্যাশা করছেন।
সদর উপজেলার দিয়ারা গ্রামে চাষি শাহিন আহম্মেদ ৭০ বিঘা জমিতে ফুলকপির চারা রোপণ করছেন। তিনি বলেন, অন্যান্য ফসলের থেকে সবজি চাষে আয় বেশি। তবে এবার বৃষ্টিতে শীতকালীন আগাম সবজির আবাদ করতে পারেননি।
দুই সপ্তাহ ধরে সবজি বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ অস্বস্তির মধ্যে রয়েছেন। বাজারে সরবরাহ কিছুটা কম হওয়ায় দামে আধিক্য বলে চাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তবে দুই দিন ধরে জেলা সদরে বাজারগুলোতে সবজির দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রবীআহ নূর আহমেদ বলেন, সবজি উচ্চমানের ফসল। সবজি চাষে চাষিরা বেশি লাভবান হয়ে থাকেন। সবজি চাষে কৃষি উপকরণগুলো চাষিরা যেন ন্যায্যমূল্যে হাতের কাছে পান, তা নিয়ে কৃষি বিভাগ সচেষ্ট রয়েছেন। এ ছাড়া নতুন সবজি চাষে কারিগরি সহায়তাও দেওয়া হয়।
সবজির দাম বেশি হওয়ার বিষয়ে রবীআহ নূর আহমেদ বলেন, এখন মৌসুমের শেষ সময়। এ ছাড়া বৃষ্টিতে অনেক জমির আগাম সবজির চারা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সরবরাহ কম হওয়ায় সবজির দাম বেশি। চাষিদের পরামর্শের বিষয়ে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, নিরাপদ সবজি উৎপাদনে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার থেকে সরে আসতে হবে।