সৌদি আরবে আগুনে পুড়ে মৃত্যু, শেষ হয়ে গেল ছোট ছেলের ‘বড় দায়িত্ব’
‘ওবাইদুল ছোট ছ্যালি হলেও সংসারের বড় দায়িত্বটা ও–ই পালন করত। ১১ বছর ধরি বিদেশ আছে। সংসারের কথা চিন্তা করি বিয়া করেনি। এবার বাড়ি আসি বিয়া করতে চাইছিল। মেয়ে দেখাদেখি করছি। কিন্তু ও নাকি আর কোনো দিন আসপি না।’ এসব কথা বলেই মূর্ছা যান মা রাহেলা বেওয়া (৭৪)।
ওবাইদুল ইসলাম (৩৪) নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার খাজুরা ইউনিয়নের চানপুর গ্রামের মৃত দবির উদ্দিন ও রাহেলা বেওয়ার ছেলে। চাকরি করতেন সৌদি আরবের হাম্মাম শহরের একটি আসবাবের দোকানে। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় ওই দোকানে আগুন লেগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে মা রাহেলা বেওয়া শয্যাশায়ী।
নাটোর শহর থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার উত্তরে হালতি বিলের মধ্যে চানপুর গ্রাম। আজ শনিবার দুপুর ১২টার দিকে গ্রামের মসজিদের পাশের রাস্তা দিয়ে ঢুকতেই দেখা গেল মানুষের ভিড়। ভিড় ঠেলে পাকা বাড়ির প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে ভেতরে একটি কক্ষে ওবাইদুলের মা রাহেলা বেওয়াকে শয্যাশায়ী অবস্থায় পাওয়া গেল। মেজ ছেলে মজনু রহমান নিহত ওবাইদুল ইসলামের ফ্রেমে বাঁধানো একটি ছবি মায়ের হাতে দিতেই তিনি উঠে বসলেন।
শাড়ির আঁচল দিয়ে ছেলের ছবিটা মুছতে মুছতে রাহেলা বেওয়া জানান, ওবাইদুল তাঁর ছোট ছেলে। ওবাইদুলের আরও ছয় ভাই ও চার বোন রয়েছে। বোনদের বিয়ে হয়েছে। ভাইয়েরা সবাই এক সংসারেই আছে। জায়গাজমি তেমন একটা নেই। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর সংসারের উন্নতির জন্য ওবাইদুল সৌদি আরবে চাকরি নেন। একটানা সাত বছর থাকার পর দেশে আসেন। চার বছর আগে আবার সৌদি আরবে যান। সংসারের কথা ভেবে এখনো বিয়ে করেননি। এবার দেশে এসে বিয়ে করার কথা বলেছিলেন। তাঁর জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু ওবাইদুল তো আর দেশে ফিরবেন না।
মেজ ভাই মজনু রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ছোট ভাই ওবাইদুলের পাঠানো টাকা দিয়ে মায়ের ওষুধ থেকে শুরু করে সংসারের সব খরচ মেটানো হতো। সর্বশেষ শুক্রবার বেলা ১১টায় মুঠোফোনে ওবাইদুল মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। মা ঠিকমতো ওষুধ খান কি না, ঈদে কোরবানির গরুর মাংস খেয়েছেন কি না ইত্যাদি কথা হয়। বিকেলে আবার ফোন দেওয়ার কথা বলে ফোন রেখে দেন। বিকেল গড়িয়ে রাত হয়, ফোন দেন না। বাড়ি থেকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেন না। অবশেষে তাঁদের প্রবাসী এক মামাতো ভাই রাত ৯টায় ফোন করে জানান, ওবাইদুল নিজ কর্মস্থলে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। পাসপোর্ট-ভিসাসহ যাবতীয় কাগজপত্র পুড়ে যাওয়ায় অন্য সাত সহকর্মীর মৃত্যুর তালিকায় তাঁর নাম ওঠেনি। ফোনে ভিডিও-ছবি দেখে তাঁরা ওবাইদুলের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।
নিহত ওবাইদুলের মরদেহ দেশে আনার ব্যাপারে জানতে চাইলে মজনু রহমান জানান, তাঁরা মায়ের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁর ভাইয়ের মরদেহ সৌদি আরবে দাফনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সৌদির পবিত্র স্থানে ওবাইদুলের কবর হোক, এটাই তাঁরা চান। একই সঙ্গে তাঁরা চান, তাঁর ভাইয়ের পাওনাদি যেন মায়ের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।