কুলাউড়ায় জঙ্গি সন্দেহে যেভাবে ধরা হলো ১৭ জনকে

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা এলাকায় জঙ্গি সন্দেহে ১৭ জনকে আটক করে স্থানীয় ইউপি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। বাইরে উৎসুক মানুষের ভিড়
ছবি: প্রথম আলো

চারটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে রোগী ও যাত্রীবেশে ১৭ জন লোক ওঠেন। একপর্যায়ে যাত্রীদের কথাবার্তা শুনে, পরনের কাদামাখা কাপড়চোপড় দেখে চালকদের সন্দেহ হয়। একে অন্যের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে সন্দেহের বিষয়টি প্রকাশ করেন। এরপর অটোরিকশা স্ট্যান্ডের কর্মকর্তাদের পরামর্শ ও সহযোগিতায় তাঁরা ১৭ জন যাত্রীকে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে জনপ্রতিনিধি ও গ্রামপুলিশ সদস্যদের কাছে তাঁদের হস্তান্তর করা হয়।

আরও পড়ুন

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নে জঙ্গি সন্দেহে এভাবেই ১৭ জন ব্যক্তিকে আটক করা হয়। আজ সোমবার সকালে ঘটনাটি ঘটে। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে জঙ্গি সংগঠন ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলার’ মূল নেতা ইমাম মাহমুদ ও চিকিৎসক সোহেল তানজিম আছেন বলে এলাকাবাসীর দাবি।

প্রথম আলোকে চালকদের একজন বলেন, সোমবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তাঁরা স্থানীয় আসকরাবাদ চা-বাগানের প্রবেশপথে গাড়ি নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় অপরিচিত এক যুবক এসে তাঁকে বলেন, তাঁদের এক লোক গাছ থেকে পড়ে কোমর ভেঙে ফেলেছেন। তাঁকে মৌলভীবাজার জেলা সদরের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ভাড়া যত লাগে দেবেন। এর পরপর আরও চারজন যুবক অসুস্থ এক বয়স্ক লোককে নিয়ে ছুটে আসেন। তাঁর গাড়িতে রোগীসহ মোট তিনজন যাত্রী ওঠেন। বাকি তিনটি অটোরিকশায় ওঠেন আরও ১৪ জন যাত্রী।

আরও পড়ুন

অটোরিকশার এই চালক বলেন, ‘গাড়িতে রোগী থাকায় গাড়ি দ্রুত চালাইয়া তিন-চার কিলোমিটার দূরে রবির বাজার চলে যাই। লুকিং গ্লাসে দেখি, রোগীর রেইনকোটে কাদা লাগানো, পায়ে জুতা নাই। যাত্রীরা কেমন যেন কথাবার্তা বলছিলেন। দুই দিন আগে এলাকা থাকি জঙ্গি ধরা হইছিল। সব মিলিয়া সন্দেহে পড়লাম। মোবাইলে বাকি তিন ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলি। তারাও সন্দেহ করছিল। রবির বাজার স্ট্যান্ডের ম্যানেজাররে জানাইলে তাইন কইলা, গাড়ি ঘুরাই সব পেসেঞ্জাররে নিয়া ইউনিয়নে যাও। খুব ডর ঢুকে গেল মনে। পরে অনেকগুলো গাড়ি আইয়া আমার গাড়ি পাহারা দিয়া আনে। বাকি তিন গাড়ি আগেই ইউনিয়নে ঢুকে পড়ে।’

বাকি তিন চালক বলেন, ইউপি কার্যালয়ে তখন স্থানীয় ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য দরছ মিয়া ও দুজন গ্রামপুলিশের সদস্য ছিলেন। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তাঁদের কাছে তুলে দেন তাঁরা। তখন একজন দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তাঁরা ধাওয়া করে তাঁকে আটকান। এর কিছু পরে কুলাউড়া থানার পুলিশ ও বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মী সেখানে যান।

কর্মধা-রবির বাজার অটোরিকশা লাইন কমিটির সহসভাপতি জামাল মিয়া বলেন, ‘এখন অনেকে বলছেন, তাঁরা ১৭ জনকে ধরেছেন। কিন্তু আসল কাজটা ড্রাইভার ভাইরা করছেন। তাঁরা ১৭ জন যাত্রী মৌলভীবাজারে নিয়া গেলে গাড়িপ্রতি এক থেকে দেড় হাজার টাকা ভাড়া পাইত। তারা টাকার লোভ করেনি। এলাকার কথা, দেশের কথা চিন্তা করছে। তাদের সারা দিন বেকার গেল।’

আরও পড়ুন

অটোরিকশার চালকদের দাবি, ১৭ জনের দলে ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলার’ মূল নেতা পলাতক ইমাম মাহমুদ ও পলাতক চিকিৎসক সোহেল তানজিম আছেন। ওই দুজনকে চিনলেন কীভাবে?—জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, গত শনিবার অভিযানের পর পুলিশের কাছ থেকে তাঁরা ছবি সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। ছবির সঙ্গে দুজনের চেহারার মিল আছে।

এলাকার কয়েকজন বলেন, শনিবারের অভিযানের পর পূর্ব টাট্রিউলির জঙ্গি আস্তানা থেকে ১৭ জন পালিয়ে কর্মধার ফানাইপুঞ্জির পূর্ব দিকে গহিন অরণ্যে আশ্রয় নেন। সেখানে বন বিভাগের জমিতে সামাজিক বনায়নের কাজে নিয়োজিত স্থানীয় শ্রমিকেরা তাঁদের দেখতে পান। পরে তাঁরা বিষয়টি জনপ্রতিনিধিদের জানান।  

স্থানীয় ইউপি সদস্য দরছ মিয়া অটোরিকশার চালকদের সহযোগিতার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আমরাও রোববার রাত থেকে খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। সবার প্রচেষ্টায় ১৭ জনকে ধরা গেছে।’

আরও পড়ুন

সোমবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আটক ব্যক্তিরা কর্মধা ইউপি কার্যালয়ের ভেতরে তালাবদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। বাইরে ব্যাপক পুলিশ পাহারা ছিল। সকাল থেকে ইউপি কার্যালয়ের বাইরে উৎসুক লোকজনের ভিড় লেগে আছে।
কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুছ ছালেক বলেন, কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের লোকজন ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছেন। তাঁরা এলে আটক ব্যক্তিরা জঙ্গি কি না, তা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে। আটক ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানাও জানা যাবে।  

এর আগে গত শনিবার সিসিটিসি কর্মধার পূর্ব টাট্রিউলি এলাকায় একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ইমাম মাহমুদের কাফেলার ১০ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাঁদের সঙ্গে ৩টি শিশুও ছিল।