গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা মৎস্য কার্যালয় ধুঁকছে জনবল–সংকটে। অর্ধেক পদ শূন্য পড়ে আছে পাঁচ বছর ধরে। এর ফলে সংকুচিত হয়ে পড়ছে মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম। মৎস্য খাবার উৎপাদনকারী ও মৎস্যচাষিদের অভিযোগ, উপজেলার মৎস্য কার্যালয় থেকে যথাযথ সেবা পাচ্ছেন না তাঁরা। অনেক সময় কার্যালয়ে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায় না।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ওই দপ্তরে মোট ছয়টি পদ আছে। পদগুলো হলো—জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা (মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা), সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা, ক্ষেত্র সহকারী, অফিস সহকারী ও অফিস সহায়ক। এসব পদের মধ্যে কেবল জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, অফিস সহকারী ও অফিস সহায়ক পদে জনবল আছে। এই তিনজনকে সব কাজ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শ্রীপুর পৌরসভাসহ পুরো উপজেলায় মৎস্য খাদ্য উৎপাদনের বড় কারখানা আছে ১১টি। নিজেরা খাদ্য উৎপাদন ও খুচরা বিক্রি করে এমন উৎপাদনকারীর সংখ্যা ৮, পাইকারি ও খুচরা মৎস্য খাদ্য বিক্রেতার সংখ্যা ১৭। এই উপজেলায় পুকুর আছে ৪ হাজার ৫১৯টি। ১টি নদী, ৩টি শাখা নদী, ১৪৫টি বিল, ৪টি খাল আছে এখানে। শ্রীপুরে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করা খামারের সংখ্যা ৭০। শ্রীপুরে মাছ চাষে জড়িত ১ হাজার ৮২০ জন খামারি। কাওরাইদ ও বরমীতে সবচেয়ে বেশি মাছের খামার আছে।
৮ থেকে ১০ বছর আগে এমনটা ছিল না। তখন মৎস্য কার্যালয়ের লোকজন প্রায়ই খামারে গিয়ে পরিদর্শন করতেন। কোথাও মুরগির লিটার ব্যবহার করলে জরিমানা করতেন। এখন তা হচ্ছে না।
মোটাদাগে উপজেলা মৎস্য কার্যালয়ের কাজ হলো এর আওতাধীন এলাকায় প্রতিবছর মৎস্য খাদ্য উৎপাদনকারী কারখানাগুলো পরিদর্শন করে ছাড়পত্র (লাইসেন্স) নবায়ন করা। কারখানাগুলোয় খাদ্যের কাঁচামাল আমদানি করলে সেগুলোর পরিমাণ ও মান যাচাই করা। উন্মুক্ত জলাশয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পুকুরে মাছের পোনা অবমুক্ত করা। ‘বিল–নার্সারি’তে রেণু অবমুক্ত করা। মৎস্যজীবীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। মৎস্য আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অভিযান পরিচালনা করা। মৎস্য–সংশ্লিষ্ট সরকারের বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করা। আধুনিক প্রযুক্তি খামারিদের কাছে হস্তান্তর ও প্রশিক্ষণ।
উপজেলার ৩৬টি খাদ্য উৎপাদনকারী, বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানসহ মাঠপর্যায়ে জলাশয়গুলো দেখভাল করা এবং অন্যান্য দায়িত্ব পালন করছেন কেবল তিনজন ব্যক্তি। এতে কোনো কাজই ভালোভাবে হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, একসঙ্গে বেশ কয়েকটি কারখানায় আমদানি করা খাদ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দরকার হলে সেদিন পুরো অফিস বন্ধ করে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
বরমী ইউনিয়নের ভিটিপাড়া গ্রামের মাছের খাদ্য উৎপাদনকারী মোশারফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে আমরা অফিসে গেলে অনেক সময় অফিসে লোকজন পাই না। তাঁরা কোনো না কোনো কাজে বাইরে থাকেন। সবশেষ একজন সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা চলে যাওয়ার কারণে আরও সমস্যা হচ্ছে।’
বরমী ও কাওরাইদ এলাকায় মাছ উৎপাদনকারী ও স্থানীয় সাধারণ বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অঞ্চলটি মাছসমৃদ্ধ হলেও সেখানে উপজেলা মৎস্য কার্যালয়ের কোনো কর্মকর্তাকে আসতে দেখেন না তাঁরা। খামারিরা জানিয়েছেন, মাছের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে নিজেরা উপজেলা মৎস্য কার্যালয়ে গিয়ে যোগাযোগ না করলে স্বপ্রণোদিত হয়ে তাঁদের কাছে কেউ আসেন না।
বরমী এলাকার মৎস্য খামারের উদ্যোক্তা আশিক বিন ইদ্রিস প্রথম আলোকে জানান, খামারের পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রোগবালাই হলে তাঁরা নিজ উদ্যোগে উপজেলা কার্যালয়ে গিয়ে সেবা নেন। ৮ থেকে ১০ বছর আগে এমনটা ছিল না। তখন মৎস্য কার্যালয়ের লোকজন প্রায়ই খামারে গিয়ে পরিদর্শন করতেন। কোথাও মুরগির লিটার ব্যবহার করলে জরিমানা করতেন। এখন তা হচ্ছে না।
উপজেলার কয়েকটি খাল ও বিলপাড়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খাল-বিলে কারেন্ট জাল ব্যবহার করা হয়। প্রচুর দেশি মা মাছ এসব জালে ধরা পড়ে। এর বিরুদ্ধে মৎস্য কার্যালয়কে তেমন কোনো ভূমিকা নিতে দেখেন না স্থানীয় বাসিন্দারা। মাওনা ইউনিয়নের জয়নাতলী গ্রামের আবদুল লতিফ বলেন, সেখানে বেশ কয়েকটি বিলে ক্ষতিকর ‘চায়না দুয়ারী’ ফাঁদ পেতে মাছ শিকার করা হয়। এসব বিষয়ে মৎস্য অফিসকে জানালেও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এতে দেশি মাছ অস্তিত্বশূন্য হয়ে যাচ্ছে।
শূন্য পদে লোক দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শ্রীপুর উপজেলার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা ওয়াহিদুল আবরার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘পদ শূন্য থাকলেও কষ্ট করে আমরা দায়িত্ব পালন করছি। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিভিন্ন জায়গায় ৪০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। আমরা দায়িত্বে অবহেলা করছি না।’