এক যুগ আগে ‘গুমের শিকার’ মুকাদ্দাসের ফেরার অপেক্ষায় মা
এক যুগ আগে রাতের বেলায় ঢাকা থেকে বাসে কুষ্টিয়ায় যাচ্ছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আল মুকাদ্দাস হোসেন (২৪) ও তাঁর বন্ধু ওয়ালিউল্লাহ (২৫)। পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তাঁদের তুলে নেওয়া হয়। দুদিন পর স্বজনেরা বিষয়টি জানার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরনা দিয়ে কোনো সন্ধান পাননি। মুকাদ্দাসের মা আয়শা সিদ্দিকা এখনো ছেলের ফেরার অপেক্ষায় আছেন। তাঁর বিশ্বাস, এক দিন তাঁর মুকাদ্দাস ফিরবেন।
আয়শা সিদ্দিকা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাঝে মধ্যে নিখোঁজ ব্যক্তিদের ফিরে আসার খবর পাই। সম্প্রতি আয়নাঘর থেকে দুজন ফেরার কথা শুনেছি। এসব শুনে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশা জাগে। ছেলে নিখোঁজ হওয়ার পর ১২ বছর পার হয়ে গেছে। এখনো ছেলের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকি।’
নিখোঁজ মুকাদ্দাস পিরোজপুর সদর উপজেলার খানাকুনিয়ারি গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসাশিক্ষক আবদুল হালিমের ছেলে। তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-ফিকহ ও আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে মুকাদ্দাস বড়। জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের বাংলাদেশ সরকারকে দেওয়া গুমের শিকার ৭৬ জনের তালিকায় মুকাদ্দাসের নাম ছিল।
আমার ছেলে কোথাও বন্দী আছে না কি তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে, আমরা এখনো জানতে পারিনি।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় যান মুকাদ্দাস। ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে তিনি ও তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু দাওয়াহ ও ইসলামী শিক্ষা বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার ওয়ালিউল্লাহর সঙ্গে রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন। বাসটি সাভারের নবীনগর এলাকায় পৌঁছলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ৮ থেকে ১০ জন লোক বাস থেকে মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহকে নামিয়ে নিয়ে যান। ওই বাসের সুপারভাইজারের বরাতে স্বজনেরা জানান, ৪ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ১২টার দিকে নবীনগর এলাকায় বাস থামিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে কয়েকজন লোক তাঁদের বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে যান।
এ ঘটনার পর ৬ ফেব্রুয়ারি মুকাদ্দাসের নিখোঁজের ঘটনায় তাঁর চাচা আবদুল হাই রাজধানীর দারুস সালাম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। ওয়ালিউল্লাহর নিখোঁজের ঘটনায় ৮ ফেব্রুয়ারি তাঁর বড় ভাই খালেদ সাইফুল্লাহ আশুলিয়া থানায় একটি জিডি করেন। এরপর নিখোঁজ দুই ছাত্রের পরিবার পুলিশ ও র্যাবসহ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিয়েও সন্ধান না পেয়ে হাইকোর্টে দুটি রিট পিটিশন করেন। ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি রিটের শুনানি হয়। শুনানি শেষে বিচারপতি আবদুল আউয়াল ও বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ তাঁদের কেন আদালতে সশরীর হাজির করা হবে না জানতে চেয়ে সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। স্বরাষ্ট্রসচিব ও আইজিপিসহ ৯ কর্মকর্তাকে তিন সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
নির্ধারিত সময়ে ৯ কর্মকর্তা আদালতকে জানান, তাঁরা দুই ছাত্রের কোনো সন্ধান পাননি। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৯ মে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি সৈয়দ মাহাবুব হোসেন হাইকোর্টের তলবের আদেশ স্থগিত করে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করতে নির্দেশ দেন। লিভ টু আপিলের শুনানি শেষে হাইকোর্টের আদেশ বাতিল করে রিট পিটিশনটি নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর বিচারপতি বজলুর রহমান ও বিচারপতি আকরাম হোসেন চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ কয়েকটি পর্যবেক্ষণসহ রিটটি খারিজ করে দেন।
মুকাদ্দাসের মা আয়শা সিদ্দিকা বলেন, মুকাদ্দাস ছোটবেলা থেকে মেধাবী। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতে পছন্দ করত। ঈদের সময় ওর কথা বেশি মনে পড়ে। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসে বন্ধুদের নিয়ে নানা আয়োজন করত। মুকাদ্দাস ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ হয়। ওই মাসের ২৫ তারিখ ছিল ওর চতুর্থ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা। এরপর মুকাদ্দাসের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করার ইচ্ছা ছিল। স্বপ্ন ছিল যুক্তরাজ্য থেকে বার অ্যাট ল শেষ করে দেশে ফিরে ব্যারিস্টার হিসেবে হাইকোর্টে আইন পেশায় যুক্ত হওয়ার।
মুকাদ্দাসের বাবা আব্দুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে কোথাও বন্দী আছে না কি তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে, আমরা এখনো জানতে পারিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন করেছে সরকার। আশা করছি, কমিশনের তদন্তের মাধ্যমে আমার ছেলের ব্যাপারে তথ্য পাব।’