বগুড়া শহরের গোদারপাড়া বাজারের খুচরা সবজির দোকানি ছিলেন মোহাম্মদ ব্রাজিলের বাবা। একসময় সবজি বিক্রির কাজে বাবাকে সহযোগিতা করতেন তিনি। একপর্যায়ে মোহাম্মদ ব্রাজিল জড়িয়ে পড়েন মাদকের কারবার, দাদনের কারবার, দখল, চাঁদাবাজি, ভাড়াটে সন্ত্রাসীসহ নানা অপকর্মে। সাধারণ সবজি বিক্রেতা থেকে হয়ে ওঠেন ‘সন্ত্রাসী ব্রাজিল’। গত শনিবার রাতে বগুড়ার কাহালু উপজেলার পোড়াপাড়া এলাকার তালুকদারপাড়া মোড়ে দুর্বৃত্তরা তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করেন।
বগুড়া শহর যুবদলের একসময়ের সভাপতি ও ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাসুদ রানার ছায়াসঙ্গী হওয়ার সুবাদে ১৫, ১৬ ও ১৭ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত চারমাথা বন্দর যুবদলের সভাপতি হন মোহাম্মদ ব্রাজিল। শুরু করেন নানা অপকর্ম। অবৈধ অস্ত্র বহন, অ্যাসিড নিক্ষেপ, ভাঙচুর, নাশকতা, ককটেল হামলা, মাদকের কারবার, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে তাঁর নামে দুই ডজনের বেশি মামলা হয়েছে। যুবদল নেতা থেকে পুলিশের নথিতে তিনি অন্তর্ভুক্ত হন ‘তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী’ হিসেবে। কয়েক দফায় গ্রেপ্তারও হন। কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে আবারও মাদকের কারবার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখেন।
বগুড়া শহরের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও শহর যুবদলের সাবেক সভাপতি মাসুদ রানা প্রথম আলোকে বলেন, ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যুবদলে সক্রিয় ছিলেন ব্রাজিল। এরপর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন কাউন্সিলের দেহরক্ষী হিসেবে ওঠাবসা শুরু করেন। ধীরে ধীরে মাদকের কারবার, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁকে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতার সঙ্গে চলাফেরা করতে দেখা গেছে।
স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ব্রাজিলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন বগুড়া শহরের গোদারপাড়া এলাকার লোকজন। বছর তিনেক আগে কয়েক হাজার এলাকাবাসী একজোট হয়ে ব্রাজিলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের ঘোষণা দেন। তাঁরা গোদারপাড়া এলাকায় ব্রাজিলকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। জনরোষে একপর্যায়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন ব্রাজিল। সেই থেকে আস্তানা গাড়েন কাহালু উপজেলার মুরইল ইউনিয়নের পোড়াপাড়া গ্রামে। যুবদল থেকে রাতারাতি আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু করেন। আওয়ামী লীগের এক নেতার ছায়াসঙ্গীও হয়ে ওঠেন। দলীয় সংসদ সদস্যসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও দেখা যায়। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় চালিয়ে যান মাদক, সন্ত্রাসী ও সুদের কারবার।
ব্রাজিল ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে অনেক মামলায় আসামি হয়েছেন। পোড়াপাড়া গ্রামের ইউপি সদস্য ছাড়াও আকতারুল, করিম, সোহেল ও তাঁদের সহযোগীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে ব্রাজিলকে হত্যা করেছেন।
কাহালুর পোড়াপাড়ায় বসে নিয়ন্ত্রণ করতেন মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, অপহরণ, ছিনতাই ও দখলের মতো অপরাধ। পোড়াপাড়া এলাকার সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্যের মাছের খামার দখল করে সেখানেই আস্তানা গাড়েন। অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে বিরোধ তৈরি হয় একাধিক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সঙ্গে। এ বিরোধের জেরেই ‘তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী’ মোহাম্মদ ব্রাজিল হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে।
নিহত মোহাম্মদ ব্রাজিলের স্ত্রীর দাবি, ব্রাজিল ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে অনেক মামলায় আসামি হয়েছেন। পোড়াপাড়া গ্রামের ইউপি সদস্য ছাড়াও আকতারুল, করিম, সোহেল ও তাঁদের সহযোগীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে ব্রাজিলকে হত্যা করেছেন।
কাহালু থানা-পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত শনিবার রাত ১১টার দিকে মোটরসাইকেলে এক সহযোগীকে নিয়ে মুরইল ইউনিয়নের পোড়াপাড়ায় শ্বশুরবাড়িতে ফিরছিলেন মোহাম্মদ ব্রাজিল। তালুকদারপাড়া মোড়ে পৌঁছালে দুর্বৃত্তরা তাঁর ওপর হামলা করে। এ সময় তাঁর মোটরসাইকেলের পেছনে থাকা তাঁর সহযোগী ভয়ে পালিয়ে যান। একপর্যায়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে মোহাম্মদ ব্রাজিলকে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করার পর দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।
মোহাম্মদ ব্রাজিলের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে তিনটি, অ্যাসিড অপরাধ দমন আইনে দুটি, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দুটি, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে পাঁচটি, বিশেষ ক্ষমতা আইনে চারটি, চাঁদাবাজির ছয়টিসহ বিভিন্ন ধারায় ২৯টি মামলা আছে।
বগুড়া পৌরসভার একজন জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ব্রাজিলরা দুই ভাই। তাঁদের বাবা স্বল্প পুঁজির সবজি দোকানি ছিলেন। সবজি বিক্রির কাজে সহযোগিতা করতেন ব্রাজিল ও তাঁর ভাই। দ্রুত বড়লোক হওয়ার লোভ থেকে ব্রাজিল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের আশীর্বাদে ২০১২ সালে যুবদলের চারমাথা বন্দর কমিটির সভাপতির পদ পেয়ে যান ব্রাজিল। এরপর নানা অপকর্মে জড়ান।
কাহালু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেলিম রেজা বলেন, মোহাম্মদ ব্রাজিলের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে তিনটি, অ্যাসিড অপরাধ দমন আইনে দুটি, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দুটি, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে পাঁচটি, বিশেষ ক্ষমতা আইনে চারটি, চাঁদাবাজির ছয়টিসহ বিভিন্ন ধারায় ২৯টি মামলা আছে। সম্প্রতি একটি মামলায় জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বের হয়েছিলেন তিনি। পূর্ববিরোধের জেরে তাঁর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। হামলাকারীদের ইতিমধ্যে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তাঁদের গ্রেপ্তারে পুলিশ অভিযান অব্যাহত রেখেছে।