‘আমার যদি কিছু হয়, মাইয়াডারে একটু দেখিস’

আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের ধনাইদ এলাকার জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন লিমিটেড কারখানার শ্রমিক ছিলেন চম্পা খাতুনছবি: প্রথম আলো

‘চম্পা আপা সব সময় হাসিখুশি থাকতেন। কখনো কারও সঙ্গে ঝামেলা করেননি। আন্দোলনের দিন আমাদের বলছিলেন, “আমার যদি কিছু হয়, মাইয়াডারে একটু দেখিস।” আমরা আপারে বলছিলাম, কিছু হবে না, চলেন। আমরা যদি ফিরা আসি, তাইলে আপনেও ফিরা আসবেন। কিন্তু আপায় তো মইরা গেল।’

আজ সোমবার ঢাকার সাভারের আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নের ধনাইদ এলাকার জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন লিমিটেড নামের তৈরি পোশাক কারখানার নিহত শ্রমিক চম্পা খাতুন সম্পর্কে এভাবে কথাগুলো বলেন তাঁর এক নারী সহকর্মী। তিন মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভের সময় গত বুধবার পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় কারখানার শ্রমিকদের। ওই সংঘর্ষে আহত হন চম্পা। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত রোববার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি।

আশুলিয়া থানা-পুলিশ ও আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ওই দিন বিক্ষোভকারী শ্রমিকেরা সড়কে বিক্ষোভের একপর্যায়ে আশপাশের কারখানা ও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েকটি টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছিল পুলিশ।

আজ সকালে ধনাইদ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন লিমিটেড কারখানার মূল ফটকে একজন নিরাপত্তারক্ষী দায়িত্ব পালন করছেন। কারখানা চত্বরে কয়েকজন পুলিশ সদস্য বসে আছেন।

কারখানার কিছুটা দূরে দিয়াখালী উত্তরপাড়া এলাকায় পাকা দেয়ালের টিনের একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে চম্পা খাতুন মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে থাকতেন। পাশেই অন্যান্য কয়েকটি বাড়িতে ভাড়া থাকেন চম্পার কয়েকজন সহকর্মী। একই এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন চম্পার স্বামীর বড় ভাই মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবাই তো ন্যায্য দাবি জানাইছে। আন্দোলনে গিয়া চম্পা মারা গেল। চম্পারে রংপুরে তার বাবার বাড়িতে দাফন করা হইছে। তার ১৪ মাসের একটা মেয়ে আছে। এখন মা ছাড়া মেয়েটা থাকবে কীভাবে?’

একই এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন কারখানার জুনিয়র লেয়ারম্যান মোরশেদা বেগম। সংঘর্ষে আহত হয়েছে তিনি। দুপুরে তাঁর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বিছানার ওপর শুয়ে আছেন মোরশেদা। সেদিনের ভয়ের ছাপ এখনো তাঁর চোখেমুখে। ডান পায়ের ওপরের দিকে কোমরের ঠিক নিচে সংঘর্ষের সময় আঘাত পেয়েছেন। মারাত্মক জখম হওয়ায় সেখানে ব্যান্ডেজ লাগানো হয়েছে। ডান হাতের তিনটি আঙুলেও ব্যান্ডেজ লাগানো। এ ছাড়া বাঁ হাতের বিভিন্ন স্থানে জখমের চিহ্ন।

মোরশেদা শুধু বলেন, ‘যাঁরা এর জন্য দায়ী, আমি তাঁদের বিচার চাই।’ মোরশেদার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর স্বামী আশরাফুল শাহ। তিনি জানান, একটি আঙুলের সামনের দিকের অংশ ছিঁড়ে গেছে। অন্য দুটি আঙুলে সেলাই দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাঁ হাতের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়েছে। ওই দিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসা শেষে রাতেই তাঁরা বাসায় চলে আসেন বলে জানান তিনি। মোরশেদার কোমরে গুলি লেগেছে বলে দাবি তাঁর।

ঘটনার দিন চম্পা ও মোরশেদার খুব কাছাকাছি ছিলেন শরীফা খাতুন। সংঘর্ষের সময় দৌড়ে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার সময় পড়ে গিয়ে তিনিসহ আরও কয়েকজন আহত হয়েছিলেন বলে দাবি তাঁর। ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘চম্পা ও মোরশেদা আন্দোলনের সামনের দিকে ছিল। পুলিশ খুব কাছে ছিল। হঠাৎ জোরে শব্দ হইল। মনে হইছে বোমা মারছে, আগুনের দলা আইসা সামনে পড়ছে। ওই সময় চম্পা ও মোরশেদা পইড়া যায়। দৌড়াইয়া একটা বাসার সামনে গিয়া আমি পইড়া গেলে আরও চার-পাঁচজন আমার ওপরে আইসা পইড়া যায়। পরে মোরশেদারে হাসপাতালে নিয়া যায়। চম্পারেও অন্যরা হাসপাতালে নেয়।’

সেদিনের ঘটনায় আহত হন চম্পার সহকর্মী ববিতা বেগম। আশুলিয়া নারী ও শিশু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে দিয়াখালী উত্তরপাড়া এলাকায় ভাড়া বাসায় ফেরেন তিনি। ববিতার সঙ্গে কথা বলার সময় দেখা যায়, তাঁর ডান হাতের কিছু স্থানে চামড়া ঝলসে গেছে। সেখানে ক্রিমজাতীয় কিছু লাগিয়ে রাখা হয়েছে।

ববিতা বলেন, ‘চম্পা আন্দোলন কইরা মরে গেল। আমি একটু দূরে ছিলাম। পুলিশ কী জানি ছোড়ল। আমার শরীরে পড়ল। জামা, ওড়না, আইডি কার্ড পুড়ে গেছে। ধোঁয়া দেখছি। একটু পর দেখি ডান হাত পুড়ে গেছে।’