বন্যার পানিতে কেন বারবার ডুবছে সিলেট
সিলেটে নদীর পাশাপাশি হাওরও নাব্যতা হারিয়েছে। প্রাকৃতিক জলাধার বেদখল হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে হচ্ছে স্লুইসগেট, বাঁধ ও সড়ক। আবাসনের জন্য যত্রতত্র একের পর এক গ্রাম তৈরি হয়েছে। এসব কারণে নদী আর হাওর সংযোগহীন হয়ে পড়েছে। তাই পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ রুদ্ধ হচ্ছে। ফলে বারবার বন্যার পানিতে ডুবছে সিলেট।
পরিবেশবিদ, প্রকৌশলী, হাওরাঞ্চলের বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তাঁরা আরও জানান, হাওরের সাত জেলার হাওর-বাঁওড় ও নদ-নদীর মধ্যে ‘কানেক্টিভিটি’ (সংযোগ) ছিল। এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা নেই। এ ছাড়া সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারায় কয়েক শ স্থানে চর জেগেছে। নদ-নদী নাব্যতা হারালেও খনন হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তো রয়েছেই। এসবই বন্যার মূল কারণ।
এ বিষয়ে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক জহির বিন আলম বলেন, সুরমা নদীসহ সব কটি নদী খনন প্রয়োজন। সিলেট নগরের ড্রেনগুলো পরিকল্পিতভাবে হয়নি। এগুলো আরও বড় করা উচিত। নগরে প্রবাহিত ছড়া (প্রাকৃতিক খাল) ও খাল আরও গভীর ও প্রশস্ত করা দরকার। তবেই বন্যার সমস্যা অনেকটা দূর হবে।
বেশি এলাকা প্লাবিত হওয়ার কারণ কী
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৮ সালের পর সিলেটে ২০২২ সালের বন্যাই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। এর বাইরে ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালের বন্যায়ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এর মধ্যে ছোট পর্যায়ে আরও কয়েকবার বন্যা হয়েছিল। চলতি বছরের ২৯ মে প্রথম দফা এবং গত সোমবার দ্বিতীয় দফায় সিলেটে বন্যা হয়। ২০২২ সালের মতো এবারও প্রচুর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সিলেট নগরের ২৩টি ওয়ার্ডের পাশাপাশি জেলায় প্লাবিত হয়েছে ১৩টি উপজেলার ১ হাজার ৬০২টি গ্রাম। এ ছাড়া সুনামগঞ্জে প্লাবিত হয় ১ হাজার ১৮টি গ্রাম। সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান জানিয়েছেন, জেলার ৮০ শতাংশ এলাকাই প্লাবিত হয়েছে।
বন্যায় এত গ্রাম প্লাবিত হওয়ার বিষয়ে কথা হয় হাওরাঞ্চলের সাতজন উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান, নয়জন কৃষক ও জেলে এবং পাঁচজন সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে। সবারই অভিমত, হাওর ও নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। এসব প্রাকৃতিক জলাধার পানি ধারণক্ষমতা হারিয়েছে। এ ছাড়া গত দুই দশকে সিলেট ও সুনামগঞ্জের নিচু এলাকায় অন্তত ১ হাজার নতুন হাটি (গ্রামের বর্ধিত অংশ) ও গ্রাম তৈরি হয়েছে। ওই সব এলাকায় এবার কোমর থেকে গলাসমান পানি।
১৯৮৮ সালের পর সিলেটে ২০২২ সালের বন্যাই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। এর বাইরে ১৯৯৮ ও ২০০৪ সালের বন্যায়ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এর মধ্যে ছোট পর্যায়ে আরও কয়েকবার বন্যা হয়েছিল। চলতি বছরের ২৯ মে প্রথম দফা এবং গত সোমবার দ্বিতীয় দফায় সিলেটে বন্যা হয়।
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অবনী মোহন দাস বলেন, নাব্যতার সংকটে ভুগতে থাকা হাওর ও নদ-নদী দ্রুত খনন করতে হবে। নতুনভাবে যেসব গ্রাম হয়েছে, সেসব গ্রামে আরও কয়েক হাত উঁচু করে বসতি নির্মাণ করা উচিত ছিল।
আবহাওয়া–বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদেরা বলছেন, আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। বিপরীতে প্রাকৃতিক জলাধারগুলোর পানি ধারণক্ষমতা কমেছে। এ ছাড়া দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকি, টাঙ্গুয়াসহ অনেক হাওরে এখন নিয়মিত পর্যটক যাচ্ছেন। অনেক পর্যটক পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতলসহ অপচনশীল দ্রব্য হাওরে ফেলছেন। সেসব গিয়ে জমা হচ্ছে তলদেশে।
ভারতের সীমান্তবর্তী সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার তিনজন সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধি জানান, সিলেট জেলার প্রায় নদ-নদীরই উৎপত্তি হয়েছে ভারতে। তাই ভারতে বৃষ্টির কারণে যে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়, এর সবই চলে আসে সিলেটে। এতে প্রচুর পরিমাণ পলিমাটিও সিলেটে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ি মাটি-বালু-পলি জমতে জমতে নদীগুলো প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। অন্যদিকে অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজ আর যত্রতত্র স্লুইসগেট ও অবকাঠামো নির্মাণের কারণে নদীর প্রবাহ সংকুচিত হয়েছে।
কোম্পানীগঞ্জের ইসলামপুর পশ্চিম ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন জানান, সুরমা, কুশিয়ারা ছাড়াও সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভারতের নদ-নদীর সঙ্গে সংযুক্ত আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নদী আছে। এসব নদীর পরিকল্পিতভাবে খনন প্রয়োজন। এসব নদীর মধ্যে আছে বাইরং, চেলা, ধোপাজান, যাদুকাটা, ধলাই, উৎমা, জাফলং, পিয়াইন ও বিছনাকান্দি।
সংযোগ হারিয়েছে হাওর-নদী
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের চার জেলায় প্রায় দেড় শ নদ-নদী রয়েছে। এর মধ্যে এক শই মৃতপ্রায়। কয়েক দশক আগেও সিলেটের নদ-নদীর সঙ্গে হাওর-বাঁওড়ের সংযোগ ছিল। এক নদীর পানি গিয়ে আরেক নদীতে মিশত। এসব পানি শেষ পর্যন্ত হাওরে গড়াত। অথচ এখন অনেক নদীর অস্তিত্বই বিলীন। এতে নদী ও হাওরগুলো অভ্যন্তরীণ সংযোগ হারিয়েছে। তাই পানি বের হওয়ার পথ কমেছে।
বাপা সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী (কিম) বলেন, সিলেটের অসংখ্য নদী ও নদীর তীর দখল করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে। নদী শাসনের নামেও নদী–বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড চলছে। এতে পানির স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
বারবার ডুবছে শহর সিলেট
সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ছড়া-খাল খননসহ জলাবদ্ধতা নিরসনে ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সিটি করপোরেশন। চলতি বছর একই খাতে সাড়ে ৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এ ছাড়া আরও প্রায় ৫৫ কোটি টাকার কাজ চলছে।
পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, হাজার কোটি টাকা খরচ করেও সিলেট নগরের জলাবদ্ধতা দূর হয়নি। চলতি মাসে ১৫ দিনের ব্যবধানে নগর পানিতে তলিয়েছে। অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণেই এমনটি হচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা শাহজালাল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক জানান, গত এক দশকে নগরে যেসব নালা নির্মিত হয়েছে, এর অধিকাংশই পরিকল্পিতভাবে করা হয়নি। ছড়া-খালের পার থেকে অবৈধ স্থাপনা পুরোপুরি উচ্ছেদ হয়নি। খনন হওয়া ছড়া-খাল আরও গভীর ও প্রশস্ত হওয়া উচিত ছিল। এ ছাড়া অনেক পুকুর-দিঘি ভরাট হওয়ায় পানি জমে থাকার স্থানও কমেছে।
এখন থেকে যেসব কাজ হবে, তা হবে পরিকল্পিত। এরই মধ্যে নতুন করে নগরের ২৩টি ছড়া-খাল সুগভীর করতে খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বন্যা ও জলাবদ্ধতার ভয়াবহতা ঠেকাতে নগরে ইন্টিগ্রেটেড (সমন্বিত) কাজ করা হবে।মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, মেয়র, সিলেট সিটি করপোরেশন
বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক মুশতাক আহমদ বলেন, ‘সিলেটের বিশাল এলাকার পানি যায় শুধু একটা চ্যানেল দিয়ে, কালনী নদী দিয়ে। সুরমা ও কুশিয়ারা একসঙ্গে হয়ে কালনী নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পানি এগোয়। বিশাল এলাকার পানি যাওয়ার জন্য এ জায়গা যথেষ্ট নয়। এ জায়গাকে ইমপ্রুভ করা দরকার। জায়গাটাকে দরকার হলে দৈর্ঘ্য-প্রস্থে আরও বাড়ানো ও গভীর করা প্রয়োজন। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ ও সিলেটের পানি বের হয়ে যাওয়ার পথও তো অনেক কমে গেছে, পানি জমা থাকার জায়গাগুলোও কমে গেছে।’
মুশতাক আহমদ আরও বলেন, ‘নদী খননের পাশাপাশি পুরো এলাকার পানি বের হওয়ার জন্য যে একটিমাত্র পথ, অর্থাৎ কালনী নদী, সেটাকে ইমপ্রুভ করলেই দ্রুত বন্যার পানি সরে যেতে পারবে। প্রয়োজনে কিছু সংযোগ খাল যদি তৈরি করা যায়, তাহলেও পানি দ্রুত বের হবে।’
এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অতীতের কাজ নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। এখন থেকে যেসব কাজ হবে, তা হবে পরিকল্পিত। এরই মধ্যে নতুন করে নগরের ২৩টি ছড়া-খাল সুগভীর করতে খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বন্যা ও জলাবদ্ধতার ভয়াবহতা ঠেকাতে নগরে ইন্টিগ্রেটেড (সমন্বিত) কাজ করা হবে। নদী খনন কিংবা শহর সুরক্ষা বাঁধ যা–ই করা হোক, সেসব সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতেই করা হবে।’