ছোটবেলা থেকে মেধাবী ছাত্র ছিলেন বেলায়েত আহমেদ (২৫)। তীব্র অভাবের মধ্যে থাকলেও পড়াশোনা ছাড়েননি। আশা ছিল, লেখাপড়া শেষে চাকরি করে ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনার দায়িত্ব নেবেন। হাল ধরবেন সংসারের। স্বপ্ন পূরণে ভর্তি হন রাজশাহী ডিপ্লোমা ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে। ভালোভাবেই শেষ করেন কোর্স। কিন্তু হঠাৎ মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে সব হিসাব পাল্টে যায় তাঁর। এখন শিকলে বন্দী হয়ে বেলায়েতের দিন কাটে ঘরের কোণে।
বেলায়েতের বাড়ি নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার খোর্দ্দকালনা গ্রামে। সম্প্রতি এক সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির বারান্দায় গোয়ালঘরের পাশে একটি চৌকিতে বসে আছেন বেলায়েত। তাঁর একটি পা বাঁধা শিকল দিয়ে। শিকলের অন্য অংশ বারান্দার কংক্রিটের পিলারের সঙ্গে বাঁধা।
বাবা শহিদুল ইসলাম পাঁচ বছর ধরে দেশের বাইরে থাকেন। মা বিলকিস বানু গৃহিণী। বেলায়েতরা তিন ভাই। ভাইদের মধ্যে তিনিই বড়। মেজ ভাই বায়েজিদ হোসেনও মেধাবী ছাত্র। তিনি নওগাঁ সরকারি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম বর্ষের ছাত্র। তিন ভাইয়ের মধ্যে ছোট ইব্রাহিম হোসেন (১২) স্থানীয় একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে।
বেলায়েতের মা বিলকিস বানু বলেন, ছোটবেলা থেকেই বেলায়েত মেধাবী ছাত্র ছিল। ২০১৩ সালে এসএসসি পাস করার পর ছেলে রাজশাহীতে ডিপ্লোমা করবে বলে জানাল। ছেলে বলল, ‘মা, আমি ডিপ্লোমাকে ভর্তি হলে চার বছরেই পড়াশোনা শেষ হয়ে যাবে। আমাকে শুধু আর চারটা বছর পড়ালেখার খরচ দাও। এরপর লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করে ছোট ভাইদের পড়াশোনার খরচ চালাব। সংসারেও সহযোগিতা করতে পারব।’ অতটুকু ছেলের কথা শুনে সেদিন তাঁর চোখে পানি চলে এসেছিল। কিন্তু আল্লাহ ওর কপালে হয়তো সুখ লিখে রাখেনি। ভালো ছেলেটা হঠাৎ করেই পাগল হয়ে গেল।
ছেলের কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন বিলকিস বানু। তিনি বলেন, ‘কত আদর-যত্নœকরেই না ছেলেটাক বড় করছি। তাঁকেই আজকে কষ্ট দিতে হচ্ছে। শিকলবন্দী করে বাড়িতে আটকায়ে রাখতে হয়। একজন মায়ের কাছে এটা যে কত কষ্টের, সেটা বলে বোঝাতে পারব না।’
পরিবারের সদস্যরা বলেন, পড়াশোনা শেষে রাজশাহীতে মেসে থেকে চাকরির খোঁজ করছিলেন বেলায়েত। একদিন বাড়িতে খবর আসে বেলায়েত অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। এরপর থেকে পরিবারের সিদ্ধান্তে তাঁর ঠিকানা হয় গ্রামের বাড়িতে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে শিকলবন্দী অবস্থায় দিন কাটছে তাঁর। শিকলে বেঁধে না রাখলে তিনি বাড়ির সবকিছু ভেঙে তছনছ করেন দেন। অকারণেই পরিবারের সদস্য ও গ্রামের লোকজনকে মারধর করেন। কখনো সবার অজান্তে সড়কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়েন। বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারেন, এ ভয়ে বেলায়েতকে রাত-দিন শিকলে বেঁধে রাখতে হয়।
বেলায়েতের ভাই বায়েজিত বলেন, ২০১৭ সালে তাঁর বাবা শহিদুল ইসলাম বিদেশ যান। সেই সময় তাঁদের সহায়সম্পদ বলতে মাত্র এক বিঘা আবাদি জমি ও কয়েক কাঠা জমির ওপর বাড়িভিটা ছিল। সেই এক বিঘা আবাদি জমি বিক্রি করে বাবা মালয়েশিয়া যান। এখন তাঁদের বড় ভাইকে ভালো চিকিৎসক দেখানোরও সামর্থ্য নেই। স্থানীয় চিকিৎসকেরা উন্নত চিকিৎসার জন্য পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিলেও তাঁকে সেখানে ভর্তি করাতে পারছেন না তাঁরা।
বেলায়েতের বিষয়টি জানানো হলে নওগাঁ জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক নূর মোহাম্মদ তাঁর পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, বেলায়েতের পরিবারের পক্ষ থেকে চিকিৎসাসহায়তা কিংবা আর্থিক সহযোগিতার জন্য আবেদন করা হলে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে যথাযথ সহযোগিতা করা হবে।