নাহিদুলকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন বাবা
১৯ জুলাই বেলা তিনটার দিকে মুঠোফোনে একমাত্র ছেলে নাহিদুল ইসলামের সঙ্গে শেষ কথা বলেছিলেন বাবা আবদুল জলিল (৬১)। তিনি বলেন, শুক্রবার নাহিদুলের অফিস বন্ধ ছিল। ফোন করে জুমার নামাজ পড়েছেন কি না, দুপুরে ঠিকমতো খেয়েছেন কি না—এসব জিজ্ঞাসা করেন ছেলেকে। তিনি ছেলেকে বলেন, এখন পথে-ঘাটে নানা ঝামেলা। তাই সাবধানে থাকতে বলেন। বিনা দরকারে ঘর ছেড়ে বের হতে নিষেধ করেন।
এর কয়েক ঘণ্টা পর ফোন আসে ছেলের বন্ধুদের। তাঁরা বলেন, নাহিদুল ‘অ্যাক্সিডেন্ট করেছে’। কথা শুনে তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। চারদিকে ফোন দিয়ে খবর নিতে থাকেন। পরে সন্ধ্যার দিকে জানতে পারেন, নাহিদুল ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরে গুলিতে আহত হন। বন্ধুরা ফুটপাত থেকে তুলে পাশের একটি হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
কথা শেষ হতে আবদুল জলিল ও তাঁর স্ত্রী বিবি ফাতেমা কাঁদতে শুরু করেন। নাহিদুলের বাড়ি বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে উত্তর বাটামারা গ্রামে। জলিল একটি স মিলে দিনমজুরের কাজ করেন।
গত বুধবার দুপুরে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ, কাঁচা রাস্তা ও বৃষ্টি উপেক্ষা করে আবদুল জলিলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছোট একটা ঘর। চারপাশে অভাবের ছাপ। বাড়ির উঠানজুড়ে কাদা। ঘরের মেঝে মাটির। চারপাশে টিনের বেড়া। ওপরে টিনের চালা।
পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দৌলতখান উপজেলার হাজিপুর ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা থেকে ২০২৩ সালে আলিম পাস করেন নাহিদুল। ভোলা সরকারি কলেজে দর্শন বিভাগে স্নাতক (সম্মানে) ভর্তি হন। পরে অভাবের তাড়নায় একটা ছোট চাকরি নেন। চাকরি শেষে বিকেল থেকে রাত অবধি ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরের ফুটপাতে জামাকাপড় বিক্রি করতেন নাহিদুল। এই আয়ের একটা অংশ প্রতি মাসের সংসার চালাতে বাবাকে দিতেন। তাঁর বড় ব্যবসায়ী হওয়ার ইচ্ছা ছিল।
জলিল বলেন, তিনি একসময় চাষাবাদের পাশাপাশি গাছের ব্যবসা করতেন। মেঘনা নদীতে দুবার ভাঙনের শিকার হন। এরপর সব হারিয়ে এখন কোনোমতে বেঁচে আছেন। ছেলেকে নিয়ে অনেক আশা ছিল তাঁরা। এখন আর সেই আশাও নেই।
জলিল বলেন, নাহিদুল থাকতেন মিরপুর ৬ নম্বরে। চাকরি শেষে আবার মিরপুর ১০ নম্বরে আসতেন জামাকাপড় বিক্রি করতে। মিরপুর ৬ নম্বরে নাহিদুলরা একসঙ্গে ৮-১০ জন থাকতেন। শুক্রবার বিকেলে পরিস্থিতি বোঝার জন্য মিরপুর ১০ নম্বরে যান তাঁরা। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় ব্যবসার মালামাল নিরাপদে রেখে বন্ধুরা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সবাই চা খেয়ে বিদায় নেন।
আবদুল জলিল আরও বলেন, ‘চা খেয়ে নাহিদুল নাকি বন্ধুদের বলছে, “তোরা যা, আমার এট্টু কাজ আছে। এই বিদায় নিয়া সাত-আট কাইত (কদম) সামনে গেছে তোরি, ওর বুহে আইয়া এট্টা (একটি) গুলি লাগজে। অর ওই বন্ধুরাই কইছে, ওরে ফুটপাতেত্তোন উডাইয়া ক্লিনিকে নিছে, হেন্তেন (ক্লিনিক থেকে) ফ্রিজিং গাড়ি কোইরা (২০ জুলাই) এই বাড়িত আনছে। এখানে জানাজা শেষে মসজিদের কাছে দাফন করা হয়েছে।”’
নাহিদুলের শোকার্ত মা বিবি ফাতিমা বলেন, ‘বিচার চাইয়া কি অইবো, আর না চাইয়া কি অইবো, তিন মাইয়ার পড়ে এট্টা পুতের মুখ দেখনে বড় খুশি অইছিলাম। হেই পুতেরে খাওয়াইয়া, না খাওয়াইয়া বড় করছি। হেই পুতরে আমার বুকেত্তোন ছিনায়া লোইয়া গেছে।’
বিবি ফাতিমা আরও বলেন, ‘আমার পুতের পড়ায় খুব মেধা আছিল। নিজে নিজেই পড়ত, কোনো প্রাইভেট দিতাম পারিনো। চাকরিবাকরি কোইররা পড়াশোনা করত। নদী ভাঙনে আমগো কিছু নাই। নিজে পড়ত, সংসার চালাইত, আমগো আউশ আবদার মিডাইত। আমার হেই সন্তানরে বুকেত্তোন ছিনাইয়া নিয়া গেছে। আমি এর বিচার চাই।’