মনিরামপুরে হামলার পর বন্ধ বাউলগানের আসর
যশোরের মনিরামপুর উপজেলায় বাউলগানের আসরের অনুষ্ঠানস্থলে আজ সোমবার দুপুরে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে। আজ সন্ধ্যা থেকে দুই দিনব্যাপী সেখানে সাধুসংঘ বাউলগানের আসর শুরু হওয়ার কথা ছিল। ওই হামলার পর বাউলগানের আসর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আয়োজকেরা জানান, বিশ্ব বাউলসম্রাট সুফি সাধক ফকির লালন শাহর স্মরণে মনিরামপুর উপজেলার পাড়দিয়া গ্রামের উত্তরপাড়ায় ফকির মন্টু শাহ নামের পরিচিত এস এম ফজলুর রহমানের বাড়িতে ১২ বছর ধরে সাধুসংঘ বাউলগানের আসর হয়ে আসছে। এ বছর ছিল ১৩তম সাধুসংঘ বাউলগানের আসর। আজ সন্ধ্যা সাতটায় বাউলগানের আসরের উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল। এরপর গানের আসর শুরু হয়ে রাত দুইটা পর্যন্ত চলার কথা ছিল। আগামীকাল সকালে আবার গান শুরু হয়ে দুপুরে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
ফজলুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ‘এবার সাধুসংঘের বাউলগানের আসরের জন্য কয়েক দিন ধরে প্রস্তুতি চলছিল। বাড়ির সর্বজনীন শান্তিধামের সামনে শামিয়ানা টানানো হয়। ডেকোরেটর থেকে ৫০টি প্লাস্টিকের চেয়ার ভাড়া করে বাড়িতে আনা হয়। রোববার রাত ১১টার দিকে উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন আমার বাড়িতে আসেন। তাঁর সঙ্গে পাশের ইউনিয়নের কাঁঠালতলা এলাকার সফিউদ্দীন ও রাজু আহমেদ ছিলেন। তাঁরা অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বলেন। আমন্ত্রিত অতিথি যাঁরা আসবেন, তাঁদের খাইয়ে বিদায় করে দিতে বলেন। কিন্তু দূরদূরান্ত থেকে আসা আমন্ত্রিত মেহবানদের জন্য আমরা গানের আসরের প্রস্তুতি নিতে থাকি।’
ফজলুর রহমান বলেন, ‘আজ বেলা সোয়া একটার দিকে একটি মোটরসাইকেলে করে তিন ব্যক্তি আমার বাড়িতে আসেন। তাঁদের মধ্যে শ্যামকুড় ইউনিয়ন ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. শামীম ছিলেন। তাঁদের একজনের হাতে দা ছিল। এরপর তাঁরা জানতে চান, অনুষ্ঠানের জন্য কত টাকা সংগ্রহ হয়েছে। ৫ হাজার ৭০০ টাকা সংগ্রহ হয়েছে বলে আমি তাঁদের জানাই। এরপর তাঁরা সর্বজনীন তীর্থধামের টিনের বেড়ায় দা দিয়ে কোপান, শামিয়ানা ছিঁড়ে ফেলেন, ব্যানার খুলে ফেলে দেন, তিনটি রডলাইট ও দুটি চেয়ার ভেঙে ফেলেন। পরে তাঁরা আমার থাকার ঘরের (খানকা ঘর) টিনের ঘরের দরজা দা দিয়ে কোপান। এরপর ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র তছনছ করেন এবং ঘরে থাকা এক হাজারের বেশি টাকা লুট করেন। তাঁরা এ সময় পাঁচ হাজার টাকা দাবি করেন। পাশের বাড়ির একজনের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা এনে তাঁদের দেওয়া হয়।’
ফজলুর রহমান আরও বলেন, ‘নিরাপত্তার কারণে সাধুসংঘের বাউলগানের আসর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমি আতঙ্কিত। আমি নিরাপত্তা চাই। ঘটনার পর একজন পুলিশ অফিসার এসেছিলেন। তিনি সব দেখে গেছেন। আমি থানায় অভিযোগ করব না।’
আজ বিকেলে পাড়দিয়া গ্রামের ফজলুর রহমানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ‘সর্বজনীন শান্তিধাম’ লেখা ঘরের ভেতরের বেড়ায় কিছু মনীষীদের ছবি সাঁটানো। বাইরে টিনের বেড়ায় লালন শাহের আঁকা ছবি। বেড়ায় লালন শাহের ছবির পেছনের দিকে দায়ের কোপের চিহ্ন। ঘরের সামনে কংক্রিটের লম্বা বেদি। বেদির ওপর বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে শামিয়ানা। ঘরের সামনে বেদিতে পড়ে আছে অনুষ্ঠানের ব্যানার। বেদির পাশে মাটিতে লম্বালম্বি পড়ে আছে চেয়ার। একটি চেয়ার ভাঙা। বেদির সামনে ছোট টিনের খানকা ঘর। ঘরের টিনের দরজায় দায়ের কোপের চিহ্ন। ঘরের ভেতরের জিনিসপত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। কয়েকজন বাউল উঠানে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের একজন রফিক বাউল এসেছেন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা থেকে।
তিনি বলেন, ‘আজ বেলা দুইটার দিকে এসে দেখি, তিনজন লোক ভাঙচুর করছে, দা দিয়ে এখানে–ওখানে কোপাচ্ছে। ১৩ বছর ধরে সাধুসংঘের এই বাউলগানের আসরে আসি। এমন ঘটনা কখনো দেখিনি।’
তবে শ্যামকুড় ইউনিয়ন ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. শামীম বলেন, ‘আজ দুপুরে আমি ওই রাস্তা দিয়ে মোটরসাইকেলে যাচ্ছিলাম। ফজলুর রহমানের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখি, স্থানীয় ও বাইরের লোকজন বাড়ির ভেতর ভাঙচুর করছেন। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাঙচুরের দৃশ্য দেখেছি। আমি কোনো হামলা ও ভাঙচুর চালাইনি। কোনো টাকাও নিইনি। আমি একজন সচেতন নাগরিক। আমি বাউলদের সম্মান করি। এখানে মেলার নামে বাইরে থেকে লোকজন এসে কেজি কেজি গাঁজা খায়। এতে ছাত্রসমাজ ও যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’
তবে অনেক চেষ্টা করেও উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
মনিরামপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) পলাশ বিশ্বাস বলেন, ‘পাড়দিয়া গ্রামে একটি অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। সেখানে আমাদের একজন অফিসারও গিয়েছিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠানে ভাঙচুরের ব্যাপারে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি।’