পৈতৃক সূত্রে পাওয়া দুই শতকের বসতবাড়ি ছাড়া কোনো চাষের জমি ছিল না রফিকুলের। অন্যের জমিতে বর্গাচাষ করতেন। এতে ঠিকমতো সংসার চলত না। বাধ্য হয়ে মাঝেমধ্যে রিকশা চালাতেন। ২০০৭ সালে কৃষি বিভাগের পরামর্শে ঘরের আশপাশে ঔষধি গাছ—কালোমেঘ, বাসক, অর্জুন ও তুলসী লাগান। এরপর এসব গাছ তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।
এখন চার বিঘা জমি ও বাড়ি-সংলগ্ন রাস্তার দুই পাশে ঔষধি গাছের চাষ করছেন কৃষক রফিকুল ইসলাম (৫৬)। নিজের জমিতে গড়ে তুলেছেন নার্সারিও। এখন তাঁর মাসিক আয় ২৫ হাজার টাকা।
রফিকুল ইসলাম গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার মহদিপুর ইউনিয়নের কেত্তারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। গ্রামের মানুষের কাছে তিনি আদর্শ কৃষক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁর সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন গ্রামের প্রায় ৩০ জন কৃষক। তাঁরাও ঔষধি গাছ লাগিয়ে এখন স্বাবলম্বী।
কেত্তারপাড়া গ্রামের কৃষক আমিরুল মিয়া (৬০) প্রথম আলোকে বলেন, ‘রফিকুল ইসলামের সাফল্য দেখে এক বিঘা জমিতে বাসক, তুলসী ও অর্জুন চাষ করছি। এ থেকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা বাড়তি আয় হচ্ছে।’
এক বিঘা জমিতে তুলসী চাষ করেছেন একই গ্রামের কৃষক বাবু মিয়া (৫৮)। তিনি বলেন, এসব ঔষধি গাছের পাতা ও ডালপালা বিক্রি করে মাসে চার হাজার টাকা আয় হচ্ছে। তাঁর মতো অনেক কৃষক রফিকুল ইসলামের দেখাদেখি ঔষধি গাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
সম্প্রতি কেত্তারপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির পাশের জমিতে লুঙ্গি পরে কাস্তে হাতে কালোমেঘ গাছের পরিচর্যা করছেন রফিকুল ইসলাম। বাড়ির কোনো জায়গা পরিত্যক্ত নেই। আঙ্গিনা ও উঠানে করা নার্সারিতে নানা জাতের ঔষধি গাছের চারা। বাড়ির পাশে বিক্রয়কেন্দ্র (কালেকশন পয়েন্ট)। এখান থেকে ঔষধি গাছের পাতা, ডালপালা ও চারা বিক্রি করা হয়।
রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সংসারে অভাব থাকায় লেখাপড়া করতে পারেননি। ছোটবেলা থেকে বাবাকে কৃষিকাজে সহায়তা করেছেন। বিয়ের পর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া দুই শতক জমিতে ঘর তুলে আলাদা সংসার শুরু করেন। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ধান-পাটের চাষ করতেন। সংসার চালাতে মাঝেমধ্যে রিকশাও চালাতে হয়েছে।
২০০৭ সালে কৃষি বিভাগের পরামর্শে ঔষধি গাছ চাষ শুরু করেন জানিয়ে সফল এই কৃষক বলেন, প্রথমে ঘরের আনাচকানাচে কালোমেঘ গাছ লাগান। পরে এক বিঘা জমি বর্গা নিয়ে বাসক, অর্জুন ও তুলসীর আবাদ করে বেশ লাভ হয়। পরে আরও তিন বিঘা জমি বর্গা নেন। এরপর ধানের চাষ ছেড়ে দিয়ে চার বিঘা জমিতে বাসক, তুলসী, অর্জুন, কালোমেঘ চাষ করছেন। নিজে কম্পোস্ট সার (জৈব সার) তৈরি করে জমিতে ব্যবহার করছেন। বাড়ির পাশে করা বিক্রয়কেন্দ্র থেকে ঔষধি গাছের পাতা, ডালপালা ও চারা বিক্রি হয়। বড় বড় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসব ঔষধি গাছের পাতা ও ডালপালা কিনে নিয়ে যাচ্ছে।
নার্সারিতে ১০ হাজার নানা জাতের ঔষধি গাছের চারা রয়েছে বলে জানিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, গাইবান্ধা ছাড়াও রংপুর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও দিনাজপুরে এসব ওষুধের চারা বিক্রি করছেন। বছরে প্রায় ১৫ লাখ টাকার চারা ও ঔষধি গাছ বিক্রি করেন। শ্রমিক ও অন্যান্য খরচ বাদে বার্ষিক প্রায় তিন লাখ টাকা আয় হচ্ছে। মাসিক আয় ২৫ হাজার টাকা। আগামী বছর আট বিঘা জমিতে ঔষধি গাছের চাষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
রফিকুল ইসলামের ছয় সদস্যের সংসার। তাঁর স্ত্রী ছালেহা বেগম (৪০) গৃহিণী। বড় ছেলে হযরত আলী বগুড়া আজিজুল হক কলেজে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ছেন। ছোট ছেলে রমজান আলী স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির ছাত্র।
বাবাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন জানিয়ে হযরত আলী প্রথম আলোকে বলেন, বাবাকে দেখে গ্রামের অনেক কৃষক ঔষধি গাছ আবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী ছালেহা বেগম বলেন, ‘স্বামীর সব কাজে আমরা সহযোগিতা করি।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্র জানায়, পলাশবাড়ী উপজেলায় দুই হেক্টর জমিতে নানা জাতের ঔষধি গাছের চাষ করা হয়েছে। প্রতি বিঘা জমিতে কালোমেঘ চাষ করতে প্রায় ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। এতে উৎপাদন পাওয়া যায় ২০ থেকে ২২ মণ। বাজারে প্রতিমণ কালোমেঘ ২ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সাধারণত কালোমেঘ চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসের মধ্যে লাগাতে হয়। ছয় মাসের মধ্যে কাটার উপযোগী হয়ে যায়। তুলসী বছরের প্রায় সব সময়ই লাগানো যায়। ৯০ দিনের মধ্যে কাটার উপযোগী হয়। বাসক একবার লাগালে ৮ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।
চাহিদা বাড়ায় আগের চেয়ে ঔষধি গাছের চাষ বেড়েছে উল্লেখ করে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, বিক্রয়কেন্দ্র ছাড়াও কৃষকেরা মাঠ থেকে এসব ঔষধি গাছের পাতা, ডালপালা ও চারা বিক্রি করতে পারছেন। দামও ভালো পাচ্ছেন। ফলে কৃষকদের মধ্যে ঔষধি গাছ চাষে আগ্রহ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগ থেকেও উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।