বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ ক্যাম্পাস এলাকায় কলেজটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় হতভম্ব বরিশালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা, শিক্ষক এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এ ঘটনাকে অনভিপ্রেত এবং দুঃখজনক বলে অভিহিত করে তাঁরা বলেছেন, পারিবারিক তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের এত বড় সংঘাতে জড়ানোর ঘটনা বরিশালে এবারই প্রথম। এমন ঘটনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এতে তৃতীয় কোনো পক্ষের ইন্ধন আছে কি না, তা–ও খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
মঙ্গলবার রাতে এ ঘটনার পর বরিশাল বিএম কলেজ ক্যাম্পাসে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিও কম। শিক্ষকদের মধ্যেও বিরাজ করছে আতঙ্ক।
গতকাল দিবাগত গভীর রাতে হওয়া এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। সকাল ১০টা পর্যন্ত বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন অন্তত ৩০ জন। তবে এই হাসপাতালে বিএম কলেজের কোনো আহত শিক্ষার্থী নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএম কলেজের অন্তত পাঁচজন শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, গত রাতের হামলায় বিএম কলেজের অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আবার হামলার শিকার হতে পারেন, এমন শঙ্কায় কেউ হাসপাতালে ভর্তি হননি।
আজ বুধবার বেলা ১১টার দিকে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ড-৪–এ আহত শিক্ষার্থীরা চিকিৎসাধীন। এই ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ নার্স প্রথম আলোকে জানান, ওয়ার্ডে এখন পর্যন্ত ৭২ জন আহত শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁরা সবাই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর মো. খোরশেদ আলমসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার বিষয়গুলো তদারক করছেন। খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা রাত বিএম কলেজ এলাকায় ছিলাম। ভোর পাঁচটার দিকে আটকে পড়া আমাদের পাঁচ শিক্ষার্থীকে নিয়ে হাসপাতালে ফিরেছি। আমাদের অনেক শিক্ষার্থী আহত। তাঁদের চিকিৎসার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি খুবই দুঃখজনক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত। আমরা সবাই এ ঘটনায় বিব্রত ও মর্মাহত।’
চিকিৎসাধীন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অষ্টম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোশারফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুনেছিলাম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে আটকে রেখে মারধর করা হচ্ছে। এ জন্য আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস নিয়ে বিএম কলেজ এলাকায় গিয়েছিলাম। কিন্তু বিএম কলেজ এলাকার পৌঁছানোর আগেই নতুন বাজার এলাকায় আমাদের বাসে হামলা হয়। বাসে যাঁরা ছিলেন, সবাই কমবেশি আহত হয়েছে। আমরা আগে-পরে কী ঘটনা ঘটেছে তার কিছুই জানতাম না।’
গতকাল রাতের সংঘর্ষ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও বিএম কলেজের অন্তত তিনজন সমন্বয়কের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, এ ঘটনাকে শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত বলাটা সমীচীন হবে না, বরং এটি পুরো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো একটি ঘটনা। একটি ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এত বড় সংঘাতের ঘটনা অনভিপ্রেত। এখানে তাঁদের বিবেক এবং শুভবোধ কাজ করেনি, প্রতিহিংসা, ক্রোধ কাজ করেছে। এটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনাবিরুদ্ধ।
সমন্বয়কেরা বলেন, বিএম কলেজ দেশের ঐতিহ্যবাহী একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী আছেন। আবার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষিণের বড় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দুটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে আন্দোলন করেছে। হামলা-নির্যাতনে কেউ কাউকে ছেড়ে যায়নি। কিন্তু এখন তাঁরাই নিজেরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে—এটা ভাবা যায় না।
দুজন সমন্বয়ক প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনার রেশ এখানেই শেষ নয়, সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো এর যে মিথস্ক্রিয়া, তা দুটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে বৈরিতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এটা সহজে ঘুচে যাওয়ার নয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এ ঘটনার পেছনে তৃতীয় কোনো পক্ষের হাত রয়েছে কি না, সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন তাঁরা।
বরিশাল বিএম কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আমিনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যা হয়েছে, সেটা আমাদের সবাইকে ব্যথিত করেছে। এটা ছিল আমাদের কল্পনার বাইরে। রাতভর এমন সংঘাত, আতঙ্ক, উত্তেজনা শুধু ছাত্র-শিক্ষক নয়, সবাইকে গভীর মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত করেছে। আমরা উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি একাডেমিক সভা আহ্বান করেছি। এ অবস্থা উত্তরণে আমরা সবার সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।’