হবিগঞ্জে মিছিলে গুলি ছোড়া সাবেক এমপির গানম্যানকে আইনের আওতায় আনার দাবি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হবিগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) মো. আবু জাহিরের গানম্যান ও পুলিশ সদস্য মাহবুব আহম্মদ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মিশে ছাত্র-জনতার ওপর শটগান নিয়ে নির্বিচার গুলি চালিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি এ–সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ওই গানম্যানের বিচার দাবি করেছেন আন্দোলনকারীরা। সেই সঙ্গে ঘটনার প্রায় দেড় মাস পরও তাঁকে আইনের আওতায় না আনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাঁরা।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, গানম্যান পুলিশের সদস্য হলেও তাঁকে বিধি মেনেই চলতে হয়। তিনি একটি দলের হয়ে এভাবে গুলি ছুড়তে পারেন না। এমনটি হয়ে থাকলে তা হবে আইনের লঙ্ঘন।
আন্দোলনকারী ও হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘হবিগঞ্জ শহরে গত ২ ও ৪ আগস্ট আমরা শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করি। এ দুটি মিছিলেই আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সংসদ সদস্য আবু জাহিরের নেতৃত্বে দলটির নেতা-কর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছোড়েন। এ সময় সংসদ সদস্যের গানম্যান মাহবুব আহম্মদকে পুলিশের পোশাক পরে একটি শটগান নিয়ে প্রকাশ্যে আমাদের ওপর গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। অথচ তিনি গত দেড় মাসেও আইনের আওতায় আসেননি।’’
একই কলেজের আরেক শিক্ষার্থী মাসুক মিয়া বলেন, ‘পুলিশ সদস্য মাহবুব আমাদের ওপর যেভাবে গুলি ছুড়েছেন, তাঁর প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। তিনি মাথায় হেলমেট পরে গুলি চালান, যাতে কেউ চিনতে না পারেন। অথচ আমরা তাঁর শারীরিক গঠন, পুলিশের পোশাক ও কোমরে রক্ষিত সরকারি পিস্তল দেখে সহজেই তাঁকে শনাক্ত করতে পেরেছি। পাশাপাশি তাঁর গুলি ছোড়ার ভিডিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাচাই করে দেখতে পারে।’
এ অভিযোগ ওঠার পরপরই মাহবুব আহম্মদ হবিগঞ্জ থেকে বদলি হয়ে গত আগস্ট মাসে রাঙামাটি চলে গেছেন। সেখানে তাঁকে জেলা পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
হবিগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও পুলিশ লাইন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর হবিগঞ্জ-৩ (হবিগঞ্জ সদর ও লাখাই) আসনের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবু জাহির নিজের নিরাপত্তার জন্য একজন গানম্যান চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শহরের চৌধুরী বাজার পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল মাহবুব আহম্মদকে দায়িত্ব দেয় জেলা পুলিশ। মাহবুব টানা ১৬ বছর ধরে তাঁর গানম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ গত ২২ আগস্ট হবিগঞ্জ থেকে বদলি হয়ে রাঙামাটি জেলায় চলে যান।
গত জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনে হবিগঞ্জ জেলা সদর বেশ উত্তপ্ত ছিল। প্রত্যক্ষদর্শী ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, গত ৪ আগস্ট দুপুরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা একটি মিছিল নিয়ে শহরের তিনকোনা পুকুরপাড় এলাকায় পৌঁছালে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকেন। এ সময় গানম্যান মাহবুব আহম্মদকে একটি শটগান নিয়ে ওই শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি ছুড়তে দেখা যায়। ওই দিন সংঘর্ষের সময় গুলিতে রিপন শীল (৩২) নামের এক যুবক নিহত হন। এ ছাড়া আহত হন ২০ থেকে ২৫ জন।
এর আগে গত ২ আগস্ট একইভাবে জেলা শহরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা গুলি চালান। ওই সময়ও মাথায় হেলমেট ও পুলিশের প্রতিরক্ষা জ্যাকেট পরে একটি শটগান নিয়ে মাহবুবকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। এ সময় তাঁর কোমরে সরকারি রিভলবার ছিল। ওই দিন গুলিতে মোস্তাক আহমেদ (৩৫) নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। এ ছাড়া আহত হন অর্ধশত মানুষ।
এ দুটি ঘটনায় হবিগঞ্জ সদর থানায় সাবেক সংসদ সদস্য আবু জাহিরসহ ৩০০ জনের বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। তবে প্রকাশ্যে গুলি ছুড়লেও মাহবুব আহম্মদকে আইনের আওতায় আনা হয়নি।
এসব বিষয়ে অভিযুক্ত মাহবুব আহম্মদের বক্তব্য জানতে তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে এবং পরে কথা বলার আশ্বাস দিয়ে সংযোগ কেটে দেন। পরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর সাড়া মেলেনি।
গানম্যান মাহবুবের গুলি ছোড়ার বিষয়ে কোনো লিখিত অভিযোগ পাননি বলে জানিয়েছেন হবিগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নুরুল আলম। তিনি বলেন, সুস্পষ্ট অভিযোগ পেলে পুলিশ তা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেবে। গানম্যান পুলিশেরই একজন সদস্য। তাঁকেও বিধি মেনেই অস্ত্র ও গুলি ব্যবহার করতে হবে।