আরেক মেয়ের নিরাপত্তা চাইলেন নোয়াখালীতে হত্যার শিকার ছাত্রীর মা
‘আমার এই একটা মেয়ে আছে এখন। তার অনেক সমস্যা। তার একটা কিডনি নাই। একটা পা নাই। আমার এই মেয়েকে তার চাচাতো ভাই ধর্ষণের চেষ্টা করেছে। এ জন্য আমি বড় মেয়েকে ঢাকায় আমার ভাইদের (মেয়ের মামা) কাছে পাঠিয়ে দিই। আমি এই বাচ্চার নিরাপত্তা চাই।’
কথাগুলো বলছিলেন নোয়াখালী শহরের লক্ষ্মীনারায়ণপুর এলাকায় খুন হওয়া স্কুলছাত্রীর (১৪) মা। গতকাল শনিবার রাতে জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এলাকায় নিজের ও মেয়ের নিরাপত্তাহীনতার কথা তুলে ধরেন।
স্কুলছাত্রী হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার সাবেক গৃহশিক্ষক আবদুর রহিম ওরফে রনি (২৮) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ বিষয়ে পুলিশ সুপারের কার্যায়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এসেছিলেন ওই ছাত্রীর মা ও বোন। পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলামের ব্রিফিং শেষে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে ওই ছাত্রীর বাবা মারা যান। এর পর থেকে দুই মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালাতেন মা। এর মধ্যে বড় মেয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী। তিনি ঢাকা থাকেন। ছোট মেয়েকে নিয়ে তিনি নোয়াখালী শহরে থাকতেন। সকালে তিনি কর্মস্থলে যান এবং সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতেন। পড়াশোনার ফাঁকে ওই ছাত্রী ঘরের সব কাজ করত।
স্বামী মারা যাওয়ার পর সম্পদ দখলে নেওয়ার জন্য পারিবারিকভাবে নানা অত্যাচার-নির্যাতন চলছে বলে অভিযোগ ওই ছাত্রীর মায়ের। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়েকে (নিহত ছাত্রী) এলাকার কিছু বখাটে ছেলে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত, নানা হুমকি-ধমকি দিত। এসব বিষয়ে এলাকার আশপাশের মানুষের কাছে গিয়েছি, বিচার চেয়েছি, কেউ বিচার করেনি। আমি মেয়রের (নোয়াখালী পৌর মেয়র) কাছে গিয়েছিলাম। মেয়র আমার সমাধান করতে পারেননি। উল্টো মেয়র বলেছেন, ‘‘আপনি কি চান, আমি ওদের সাথে মারামারি করি?’’ তখন আমি তাঁকে (মেয়র) বলেছি, ‘‘আপনি একজন মেয়র হয়ে যদি সমাধান করতে দিতে না পারেন, তাহলে আমি আর কী বলব।’’’
পাশে থাকা বড় মেয়েকে দেখিয়ে ওই মা বলেন, ‘বাড়ির ভবনের তৃতীয় তলা আমার স্বামী মারা যাওয়ার আগে তাঁর মেয়ের জন্য তৈরি করেছিলেন। তিনি মেয়ের জন্য সেখানে টয়লেটে হাইকমোড বসিয়েছিলেন। কিন্তু সেই তৃতীয়তলাটি তারা জোরপূর্বক নিয়ে গেছে। এ ঘটনা এলাকার সবাই জানে। কিন্তু কেউ এর কোনো বিচার করেনি। আমি আজ বাচ্চার মা নই, একজন সাধারণ মানুষ। আমি আমার এই বাচ্চার নিরাপত্তা চাই।’
ছাত্রীর মা আরও অভিযোগ করেন, ‘আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হয়। আমি মেয়রসহ সমাজের সবার কাছে গিয়েছি, কোনো বিচার পাইনি। একটা নারী কতটা অসহায় হতে পারে। আমি মানুষের কাছে যাই বলে আমার জায়েরা বলে, আমার সঙ্গে মানুষের অবৈধ সম্পর্ক আছে। এ জন্য আমি বলেছি, আর কারও কাছে যাব না। নিরাপত্তা আল্লাহর কাছে চাইব।’
মায়ের পাশে থাকা নিহত ছাত্রীর বড় বোন বলেন, ‘আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতাম বলে ঢাকায় চলে গেছি। আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, আমি ঢাকা কেন গেছি? মাকে ছেড়ে কেন গেছি? আমার বোন বাসায় একা, আমি ঢাকায় চলে যাই পড়ার জন্য। এ জায়গায় আমার কোনো নিরাপত্তা ছিল না। মা আমাদের জন্য চাকরি করত। এ জায়গাটা আমার কাছে একটা নরক। আমরা আমাদের নিরাপত্তা চাই, আর ওই নরপশুর (স্কুলছাত্রীর হত্যাকারী) ফাঁসি চাই।’
নিহত ছাত্রীর মায়ের করা অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য নোয়াখালী পৌরসভার মেয়র সহিদ উল্যাহ খানের মুঠোফোনে আজ রোববার সকালে একাধিকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন না ধরায় এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
ছাত্রীর মায়ের করা অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে সুধারাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগগুলোর প্রতিটি তাঁরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। হত্যার ঘটনার পর ওই রাতেই (বৃহস্পতিবার) ছাত্রীর চাচাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তাঁকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত শেষে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগের বিষয়ে ওসি আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ছাত্রীর পরিবারকে বলে দেওয়া হয়েছে, যেকোনো সমস্যা তাৎক্ষণিক থানায় জানাতে। থানা-পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার রাতে শহরের লক্ষ্মীনারায়ণপুর এলাকার একটি বাসায় স্কুলছাত্রীর (১৪) গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। পরিবারের অভিযোগ ছিল, অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা তাকে ধর্ষণের পর গলা কেটে হত্যা করেছে। ছাত্রীর মা এ ঘটনায় থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেছেন।
মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার ছাত্রীর প্রাক্তন গৃহশিক্ষক আবদুর রহিম আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার কথা বলার পর ওই ছাত্রীকে তিনি প্রথমে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেন। পরে গলা ও হাতের রগ কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করার কথা স্বীকার করেছেন আবদুর রহিম।