মানুষের মঙ্গল হোক, বলতেন সৈয়দ মহিউদ্দিন
অসুস্থ শিল্পীকে দেখতে একবার তাঁর কাতালগঞ্জের বাসায় গিয়েছিলাম আমরা কজন। সরু গলি পার হয়ে অতি ছোট পরিসরে অন্ধকার একটা ঘরে তাঁর সঙ্গে অনেকক্ষণ কাটিয়ে আলো নিয়ে ফিরেছিলাম। আমাদের দেখেই ভুলে গিয়েছিলেন নিজের অসুস্থতার কথা। শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। একসময় উঠে বসলেন। প্রবল উদ্দীপনায় কথা বলছিলেন। ফেলে আসা জীবনের নানা বাঁকের কথা তুলে ধরছিলেন। মনে হচ্ছিল, অতীতের ভান্ডার থেকে একেকটা আলোর টুকরা এনে আমাদের হৃদয়ের দিকে ছুড়ে মারছেন। হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছেন, এই জীবনের ছুটির ঘণ্টা বেজে গেছে। তাই অভিজ্ঞতার যত মানিক–রতনে সমৃদ্ধ হয়েছেন, সব বিলিয়ে দিতে চেয়েছেন।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তি সৈয়দ মহিউদ্দিন দীর্ঘদিন অসুখে ভুগে আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। চৈত্রের ঝোড়ো হাওয়ার এই দিনে পাগলা বাতাসে তাঁর গানের সুর ভেসে বেড়াচ্ছে। ভেসে বেড়াচ্ছে তাঁর অকৃত্রিম সেই সম্ভাষণ। ছোট–বড় যে কাউকে দেখার সঙ্গে দুই হাত ঊর্ধ্বে তুলে বলতেন, ‘মঙ্গল-মঙ্গল। আপনার মঙ্গল হোক। মানুষের মঙ্গল হোক।’
সৈয়দ মহিউদ্দিনের জীবনের সব কর্ম, সৃষ্টির মূল কথাই ছিল মঙ্গল কামনা। তিনি বলতেন, ‘আমরা যা কিছু করি তার শেষ গন্তব্য নিশ্চয়ই মানুষের ভালোর জন্যই কিছু করে যাওয়া। আর দুনিয়ার ইতিহাস হচ্ছে ভালো–মন্দের চিরকালের লড়াই।’ এই লড়াই দেহ আর প্রাণের চিরন্তন লড়াইয়ের মতো। দুটোর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। দেহ বলে, ‘আমি তোকে আশ্রয় দিয়েছি।’ প্রাণ বলে, ‘আমি ছাড়া তুই অচল, যেদিন আমি উড়াল দেব, তোর ব্যবস্থা কই?’ দুয়ের দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে মহিউদ্দিন বলেন, ‘আছে বলে পরান পাখি, গায়ের জোরে হাঁকাহাঁকি/দমের হাওয়া অবিশ্বাসী/ পুট্টুস কইরা দেহ ছাড়ি ধাইতে কতক্ষণ।’
জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষণ, মানুষের কথাবার্তা, আচার-আচরণ, উৎসব, সংস্কৃতি ও প্রকৃতি থেকে গানের বিষয় তুলে আনতেন মহিউদ্দিন। তিনি ছিলেন জীবনবাদী ও জীবনরসিক। জীবনের শেষ দিকে দেখা হলেই তার জনপ্রিয় সব গানের রচনার পটভূমি বলতেন। জীবন-বাস্তবতার খনি থেকে হীরার মতো তুলে আনা সেই গানের রচয়িতাকে কেউ চেনে না। মহিউদ্দিন সে রকমই লোকচক্ষুর অন্তরালের এক শিল্পী। যাঁর অনেক গান লোকগানের মর্যাদায় মানুষের মুখে মুখে ফেরে। শুধু শেফালি ঘোষের জন্য তিনি লিখেছেন শতাধিক গান। নতুন প্রজন্মের বহু শিল্পী তাঁর গান গেয়ে মঞ্চ মাতাচ্ছেন।
বঙ্গোপসাগরে উপকূল, কর্ণফুলীর দুই পাড়ের জনপদ, সেখানকার মানুষের হৃৎস্পন্দনকে ধরতে পেরেছেন তিনি। তাঁদের সুখ–দুঃখকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তাঁদের জীবনের আখ্যানগুলোই তিনি তাঁর সহজাত কাব্যপ্রতিভায় সুরের মায়া দিয়ে তুলে এনেছেন। শ্রেণিবিভক্ত সমাজের নির্মম চিত্রও তাঁর গানে পাওয়া যায়। মেজ্জান হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের গণখাওয়াদাওয়ার আয়োজন নিয়ে তাঁর বিখ্যাত গানের উদাহরণ দেওয়া যায়।
‘মেজ্জান দিয়ি মেজ্জান দিয়ি ঐতারথ/ গরিবুল্লাই মাইট্টা বচি, ডর মাইনসুল্লাই বাসনত/ কী সুন্দইরগ্য বিছানত।’
(মেজবানি দিয়েছে ওরা, গরিবেরা খাবে মাটিতে, বড়লোকেরা বাসনে)
চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জলযান সাম্পান নিয়ে কত গান, কত সাহিত্য। কিন্তু মহিউদ্দিনের গানে অন্যরকম বাস্তবতা। সেখানেও দ্বন্দ্ব। সাম্পান মাঝি আগের মতো যাত্রী পায় না। যুগের পরিবর্তনে, নদীতে যন্ত্রচালিত বোট নেমেছে। মানুষ আর সাম্পানে চড়তে চায় না। কালের বাঁকবদলের সময় একটি পেশাজীবী শ্রেণির ভাগ্যেরও যে বাঁকবদল হয়ে সাম্পানওয়ালারা যে হারিয়ে যাচ্ছে তার করুণ বিবরণ পাওয়া যায় তার গানে।
‘গর্কি তুয়ান-বইন্যা-খরা মোহামারি ঘুন্নিঝড়/ ভাসায় মারে ধ্বংস গরে, মাইনসে তো আর বই ন লর/ অক্কল হামর ধান্দা চলে আবার নয়া সিষ্টি অর।’
(ঝড়–বাদল–বন্যা ধ্বংস করলেও মানুষ বসে থাকে না। আবার নতুন করে সৃষ্টির নেশায় মাতে।)
মহিউদ্দিনের লেখায় চট্টগ্রামের মানুষ, প্রকৃতি, সংস্কৃতি, এখানকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনের বিশাল প্রেক্ষাপট নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে। মহিউদ্দিন বলেছিলেন, চাঁটগাইয়া ভাষার বিকৃতি আমার ভালো লাগে না। এই ভাষায় যে জোর, এর যে মেজাজ, যে অলংকার তা বাংলা ভাষা থেকে আলাদা। আজকাল অনেকেই বাংলা ভাষার শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে চাঁটগাইয়া গান গায়। তাতে এই আঞ্চলিক ভাষাটির আমেজ, মূল সুর, আর প্রকৃত চরিত্রটি পাওয়া যায় না।
মহিউদ্দিন প্রকৃত শিল্পী। প্রকৃতির নিজ হাতে গড়া শিল্পী। চট্টগ্রামের ভাষা থেকে, নদী থেকে, মাটি থেকে জাত এক শিল্পী। কালের বিবর্তনে বহু ভাষা, বহু সংস্কৃতি, বহু আচার হারিয়ে যায়। কিন্তু চট্টগ্রামের কিছু হারাবে না। কেননা এখানে একজন মহিউদ্দিন ছিলেন। ডিসি পাহাড়ে এক অনুষ্ঠানের পর মঞ্চ থেকে নামতে গিয়ে পা ভেঙেছিলেন তিনি। সেই থেকে প্রায় পঙ্গু–নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন। বহুদিন ছিলেন ঘরবন্দী। কিন্তু মন ভাঙেনি। তিনি নয়াগাছের নতুন শাখার মতো বিরামহীন জাদু দেখিয়েছিলেন তিনি। সেই জাদুর ঘোর কাটতে আমাদের অনেক কাল লাগবে।