কুমিল্লার বরুড়ায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ এন এম মইনুল ইসলাম স্বাক্ষর না করায় ফেরত গিয়েছিল উন্নয়ন বরাদ্দের ৫০ লাখ টাকা। প্রকল্পটি এনেছিলেন কুমিল্লা-৮ (বরুড়া) আসনের আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য নাছিমুল আলম চৌধুরী। এবার সংসদ সদস্যের অনুসারী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানদের আপত্তিতে আটকে গেছে প্রায় চার কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সংসদ সদস্য (এমপি) ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের বিরোধে এলাকার উন্নয়নকাজ ব্যাহত হচ্ছে। যে কারণে প্রকল্পের কাজ আটকে যাচ্ছে, বরাদ্দও ফেরত যাচ্ছে। এতে উন্নয়নবঞ্চিত হচ্ছেন এলাকাবাসী। কারণ হিসেবে সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান একে অপরের বিরুদ্ধে ‘অনিয়মের’ অভিযোগ তুলেছেন।
নাছিমুল আলম চৌধুরী কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বরুড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি ২০০৮ ও ২০১৮ সালে দুবার আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করে জয়ী হন। এ এন এম মইনুল ইসলাম বরুড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। ২০১৯ সালে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন। তিনি কুমিল্লা-৮ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত আবদুল হাকিমের ছেলে। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এই দুই নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
টাকা ফেরত গেলে অথবা প্রকল্প আটকে গেলে বঞ্চিত হন সাধারণ জনগণ। জনপ্রতিনিধিদের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে এলাকার উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
উপজেলা প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে উপজেলা উন্নয়ন সহায়তা খাতের অধীন ‘অনগ্রসর উপজেলা বিবেচনায় স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী বরাদ্দ’ উপখাতের আওতায় ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ আনেন নাছিমুল আলম চৌধুরী। গত ১৯ জুন সংসদ সদস্য উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে সড়ক সলিংকরণের জন্য প্রকল্প তালিকা দেন। কিন্তু উপজেলা চেয়ারম্যান এ এন এম মইনুল ইসলাম ‘কাজ শেষ না করায়’ টাকা ছাড় দেননি। নিয়মানুযায়ী, ৩০ জুনের মধ্যে ওই টাকা খরচ করার কথা। ফলে ওই টাকা ফেরত যায়। এ নিয়ে ক্ষুদ্ধ হন নাছিমুল আলম চৌধুরী।
এ বিষয়ে এ এন এম মইনুল ইসলাম বলেন, ‘যেখানে কাজই শুরু হয়নি, সেখানে কাজের বিলে সই করার মতো দুর্নীতি আমি করতে পারি না।’
নাছিমুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘সাধারণত প্রকল্প করে ওই টাকা উপজেলা প্রকৌশল দপ্তরের হিসাবে রাখা হয়। পরে কাজ করে বিল দেওয়া হয়। টাকাও এনেছি জুন মাসের শেষের দিকে। অর্থবছর শেষ হওয়ার আগে। উপজেলা চেয়ারম্যান এতে সায় দেননি। ফলে উন্নয়ন বঞ্চিত হলো বরুড়াবাসী।’
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উপজেলা উন্নয়ন তহবিলের আওতায় গত ১৩ জুলাই বরুড়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের সড়ক পাকাকরণ, কালভার্ট নির্মাণ, রিটার্নিং দেয়াল নির্মাণকাজের প্রকল্প নেওয়া হয়। এতে ৫৩টি প্যাকেজে ৮৮টি কাজের জন্য ৩ কোটি ৮২ লাখ ২৬ হাজার ২২৭ টাকার প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে দরপত্র আহ্বান করা হয়। যাতে অংশ নেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারেরা। তবে এ প্রকল্প নিয়ে আপত্তি তোলেন উপজেলার ১৩টি ইউপির চেয়ারম্যানরা। তাঁরা দাবি করেন, উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খেয়াল খুশিমতো প্রকল্প নিয়ে দরপত্র নোটিশ জারি করেন। এতে তাঁদের মতামত নেওয়া হয়নি।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কাছে দরপত্র প্রক্রিয়া বাতিলের জন্য আবেদন করেন ইউপি চেয়ারম্যানরা। এরপর ১০ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগ কুমিল্লার সহকারী কমিশনার দেবাশীষ অধিকারী দরপত্র কার্যক্রম স্থগিত রাখার জন্য ইউএনওকে চিঠি দেন। চিঠি দেওয়ার পরও উপজেলা প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম ১২ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টা ১৬ মিনিটে দরপত্র উন্মুক্ত করার ই-নথিতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু ইউএনও স্থানীয় সরকার বিভাগ কুমিল্লার চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এতে সই করেননি।
এমন পরিস্থিতিতে দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শাহ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. জসীম উদ্দিন শাহ গত ১২ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব বরাবর চিঠি দেন। দরপত্র জমা দেওয়া ১৫ জন ঠিকাদারদের পক্ষে চিঠিতে উল্লেখ করেন, নিয়মানুয়াযী দরপত্র জমা দেওয়ার পর ৩০ মিনিটের মধ্যে সেটি উন্মুক্ত (ওপেন) করতে হয়। কিন্তু ১২ সেপ্টেম্বর উপজেলা প্রকৌশলী এতে সই করলেও ইউএনও সেটিতে সই করেননি।
পরে ৫ নভেম্বর স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপজেলা-২ শাখার যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম মজুমদার পিপিআর-২০০৮ অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইউএনওকে চিঠি দেন।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক খন্দকার মু. মুশফিকুর রহমান বলেন, চেয়ারম্যানদের অভিযোগ নিয়ে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পংকজ বড়ুয়াকে তদন্ত দেওয়া হয়েছে। ২০ থেকে ২৫ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। এরপর এ নিয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।
ঠিকাদার মো. জসীম উদ্দিন শাহ বলেন, ‘মন্ত্রনালয়ের নির্দেশ সত্ত্বেও ইউএনও ইজিপির দরপত্র খোলেননি। আমরা ঠিকাদারেরা ঋণ নিয়ে দরপত্রে অংশ নিয়েছি টাকা খরচ করে। এতে আমরা ভোগান্তিতে আছি।’
এ বিষয়ে ইউএনও সাবরিনা আফরিন মুস্তফা গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার বিভাগ কুমিল্লা থেকে ওই দরপত্র কার্যক্রম ১০ সেপ্টেম্বর স্থগিত করা হয়। স্থগিত হওয়ার পর আমি তো ১২ সেপ্টেম্বর এতে সই করতে পারি না। উন্মুক্ত করতে পারি না। পরবর্তী সময় মন্ত্রণালয় থেকে পিপিআর অনুসরণ করে নির্দেশনা দিয়ে চিঠি এসেছে। এ নিয়ে করণীয় কী, তা জানতে ৫ নভেম্বরই জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছি।’
দরপত্র আহ্বান কমিটির সদস্যসচিব ও উপজেলা প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি দরপত্র উন্মুক্ত করার স্থানে ক্লিক করেছি। ইউএনও করেননি। আমার কাজ আমি করেছি।’
বরুড়া উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, উপজেলার বেশির ভাগ ইউপি চেয়ারম্যান সংসদ সদস্যের অনুসারী। ইউপি চেয়ারম্যানদের বাদ দিয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ওই প্রকল্প নেন। এতে ক্ষুব্ধ হন সংসদ সদস্য ও তাঁর অনুসারী চেয়ারম্যানরা। উপজেলার গালিমপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. রবিউল আলম বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত না নিয়েই প্রকল্প নেওয়া হয়। ওই কারণে আমরা সব চেয়ারম্যান ক্ষুব্ধ। এ ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানদের মতামত ও তাঁদের প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাই দরপত্র কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।’
জানতে চাইলে দরপত্র আহ্বান কমিটির আহ্বায়ক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ এন এম মইনুল ইসলাম বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে উপজেলার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেওয়ায় আওয়ামী লীগের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। নিয়মমতো দরপত্র জমা দেওয়ার ৩০ মিনিটের মধ্যে সেটি উন্মুক্ত করতে হবে। কিন্তু গত প্রায় দুই মাসেও সেটি উন্মুক্ত করা হয়নি। বিধি মোতাবেক সব ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দরপত্র আহ্বান করা হয়।
এ বিষয়ে নাছিমুল আলম চৌধুরী বলেন, এই ধরনের প্রকল্পে সাধারণ ইউপি চেয়ারম্যানরা ৮০ শতাংশ ও উপজেলা চেয়ারম্যান ২০ শতাংশ প্রকল্প দেন। এখানে তার উল্টো হয়েছে। ইউপি চেয়ারম্যানদের না জানিয়ে প্রকল্প নেওয়া হয়। দরপত্র আহ্বান করা হয়। ওই প্রক্রিয়া বিধি মোতাবেক হয়নি। ওই কারণে ইউপি চেয়ারম্যানরা আপত্তি জানিয়েছেন। এর সঙ্গে সংসদ সদস্যের কোনো সংশ্লিষ্ট নেই।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কুমিল্লার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন, এমনিতেই এলাকার উন্নয়নের জন্য চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ কম। তার মধ্যে টাকা ফেরত গেলে অথবা প্রকল্প আটকে গেলে বঞ্চিত হন সাধারণ জনগণ। জনপ্রতিনিধিদের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে এলাকার উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।