‘ঠান্ডা মনে হয় মোক বাঁচি থাকপের দিবার নেয়’
তিন দিন ধরে সূর্যের দেখা নেই। পৌষে ঠান্ডার তীব্রতায় সাধারণ মানুষ জবুথবু হয়ে পড়েছেন। পশুপাখিরও কাহিল অবস্থা। কুয়াশা আর হিমেল বাতাসে মানুষ অনেকটা কুঁকড়ে গেছেন। শীতবস্ত্রের অভাবে গ্রামগঞ্জে দিনভর খড়কুটোয় আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। গরম কাপড়ের জন্য অনেকে ধরনা দিচ্ছেন জনপ্রতিনিধিদের বাড়িতে।
রংপুরের বদরগঞ্জ ও তারাগঞ্জ উপজেলায় শীতে টিকে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বদরগঞ্জের আমরুলবাড়ি গ্রামের আমেনা বেগমের বয়স ৭৫ ছুঁই ছুঁই। ছেলেসন্তান নেই। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। স্বামী মারা গেছে চার দশক আগে। স্বামীহারা মেয়ে শেফালি বেগমের বাড়িতে উঠেছেন। অর্থনৈতিক সংকটে মেয়েরও ত্রাহি অবস্থা। আমেনা চলাফেরা করতে পারলেও বয়সের ভারে কোনো কাজ করতে পারেন না।
আজ শুক্রবার জরাজীর্ণ শাড়ি পরে প্রথম আলোর বদরগঞ্জ প্রতিনিধির বাড়িতে আসেন। ঠান্ডায় কাঁপছিলেন। আড়ষ্ট গলায় কথা যেন হচ্ছিল না। বোঝা গেল, তিন দিনের ঠান্ডা ও হিমেল বাতাস তাঁকে কাবু করে ফেলেছে। বললেন, ‘ভাই, মোর খুব কষ্ট। একটা কম্বলের ব্যবস্থা করি দ্যান। তিন দিন থাকি খুব ঠান্ডা। এই ঠান্ডা মনে হয় মোক আর বাঁচি থাকপের দিবার নেয়। গাও খালি কাঁপোছে, হাত–পাও সিষ্টি নাগোছো। মানুষ কইছে, তোরায় কম্বল দিবার পারমেন। মোক একটা কম্বল দিয়া বাঁচাও ভাই।’
বদরগঞ্জের জেলেপাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে চিকলি নদী। পারেই হতদরিদ্র জেলেখা বেগমের (৫৫) বাড়ি। দেখা গেল গ্রামের ভেতরে অনেকেই খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। গ্রামের ভেতরে ঢুকতেই গরম কাপড়েও নদীর হিমেল বাতাসে শরীর কেপে ওঠে। জেলেখা বেগম বলেন, ‘ভাঙা ঘর। নদীর হড়হড়া বাতাসে জেবনটা ব্যারে যাওচে। তিন দিন থাকি মাটিত পোয়াল (ধানের খড়) বিচিয়া আছি। হামাক দেখার কাঁয়ও নাই। মেম্বারের গোড়োত গেচনু। কইলো, “কম্বল আসলে দেমো।” তোমরায় কনতো বাবা, ঠান্ডা পালে যায়া কম্বল নিয়া মুই কী করিম!’
বদরগঞ্জের দামোদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ঠান্ডায় তাঁর নিজেরই কাহিল অবস্থা। তিন দিন ধরে ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। গরিব মানুষেরা কম্বলের জন্য বাড়িতে আসছেন। কাল (শনিবার) সরকারিভাবে ইউনিয়নে ২৫০টি কম্বল বরাদ্দ পাওয়ার কথা। চাহিদার তুলনায় তা খুবই সামান্য।
বদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজির হোসেনের সরকারি মুঠোফোন নম্বরে কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া যায়। এ জন্য সরকারিভাবে উপজেলায় কম্বল বরাদ্দ বা বিতরণের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তারাগঞ্জের ছুটমেনানগর গ্রামের বৃদ্ধা মঞ্জিলা বেগমকে আজ বেলা তিনটার দিকে নিজের বাড়ির উঠানে আগুন পোহাতে দেখা গেল। তিনি বলেন, ‘তিন দিন থাকি বেলা দেখা যাওছে না। ঠান্ডা বাড়ছে। আগুন তাপেয়াও গাওত (গায়ে) উসুম ধরোছে না।’ মঞ্জিলার সঙ্গে শিশুসন্তান কোলে নিয়ে আগুন পোহাচ্ছিলেন পাশের বাড়ির গৃহবধূ মৌসুমী বেগম। তিনি বলেন, ‘এবার পৌষ মাসের শুরু থাকি ঠান্ডা বেশি। রাইতোত বৃষ্টির মতোন শীত পড়ে। কোনো রকম ছিঁড়া খ্যাতা জড়ে পল্টে থাকি। সকালের ঠান্ডাত ছাওয়াটা কাঁপোছে। সেই তকনে আগুন পোয়াওচি।’
তারাগঞ্জের ইকরচালি গ্রামের ইউপি সদস্য রবিউল ইসলাম বলেন, ‘সেই সাতসকাল থেকে মানুষ বাড়িতে আসছে কম্বল পাওয়ার আশায়। বরাদ্দ পেলে দেব—এই আশ্বাস দেওয়া ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। কঠিন ঠান্ডায় গরিব মানুষ খুব কষ্ট পাচ্ছেন।’
তারাগঞ্জের ইউএনও রুবেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, এবার আড়াই হাজার কম্বল বরাদ্দ পেয়েছেন। এর মধ্যে গ্রাম ঘুরে প্রায় দুই হাজার কম্বল বিতরণ করেছেন। বাকি কম্বলও বিতরণ করা হচ্ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ অনেক কম বলে তিনি জানান।