সরকার পতনের দিন ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের বীর পশ্চিমপাড়া জেলেপাড়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ভয়ে গৃহবধূ ও নারীরা জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। গ্রামের মুসলিম পরিবারগুলো এগিয়ে এলে সংখ্যালঘু পরিবারগুলো রক্ষা পায়। হামলার পর দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হলেও এখনো আতঙ্ক কাটেনি। বিএনপির নেতারা হিন্দুদের পাশে থাকার আশ্বাস দিলেও এখনো প্রশাসনের কেউ ঘটনাস্থলে যাননি।
৫ আগস্ট বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ২৩টি পরিবার আক্রান্ত হয় বলে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা জানান। আজ বুধবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ২১টি পরিবার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। দুটি ঘটনার সত্যতা সরেজমিনে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
রামগোপালপুর ইউনিয়নের বীর পশ্চিমপাড়া গ্রামের জেলেপাড়ায় অন্তত ১৫০টি হিন্দু পরিবারের বসবাস। কার্তিক চন্দ্র বর্মণের উঠানে একটি মন্দির আছে। মন্দিরের আশপাশের ঘরে কোপের চিহ্ন দেখা যায়। স্বপন চন্দ্র বর্মণ, কার্তিক চন্দ্র বর্মণ, নরেশ চন্দ্র বর্মণ, কাজল চন্দ্র বর্মণ, উজ্জ্বল চন্দ্র বর্মণ ও অনিল চন্দ্র বর্মণের বাড়িতে হামলা হয়। মন্দির চত্বরে বসে আজ সকালে তাঁদের সঙ্গে কথা হয়।
এলাকাবাসী জানান, ৫ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে এক–দেড় শ লোক লাঠিসোঁটা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে হামলা করে। ঘরের বেড়া, দরজা-জানালায় কোপাতে থাকে। হামলার সময় বাড়িতে পুরুষেরা ছিলেন না। বাড়ির বৃদ্ধারা পুত্রবধূ ও মেয়েদের বাড়ির পেছনে জঙ্গলে লুকিয়ে সামনে এগিয়ে যান। অনুনয়-বিনয় করে হামলাকারীদের দমানোর চেষ্টা করেন। পরে হিন্দু পরিবারগুলোকে রক্ষায় আশপাশের মুসলিম পরিবারগুলো এগিয়ে এলে হামলাকারীরা চলে যায়।
প্রবাসী রানী বর্মণ বলেন, হামলার সময় দ্রুত পুত্রবধূকে বাড়ির পেছনে জঙ্গলে লুকিয়ে সামনে এসে দাঁড়ান। তখন দুজন তাঁর সামনে এসে বলতে থাকেন, সামনে থেকে না সরলে মেরে ফেলবেন। তিনি তাঁদের অনেক অনুরোধ করেন। এরপরও তাঁরা ঘরের জানালা, দরজা কোপায়।
সত্যেন্দ্র চন্দ্র বর্মণ বাড়িতে ছেলের ভাঙা মোটরসাইকেলটিকে দেখিয়ে বলেন, ‘হামলার পর বিএনপির দুজন নেতা এসে আমাদের সাবধানে থাকতে বলে গেছেন। কোনো সমস্যা হলে তাঁদের জানাতে বলেছেন। কিন্তু প্রশাসনের কেউ আসেনি।’ তিনি আরও বলেন, ওই ঘটনার পর আর কিছু না হলেও এখনো সবার মধ্যে একধরনের আতঙ্ক আছে।
কার্তিক চন্দ্র বর্মণ বলেন, ওই দিন হামলার সময় তাঁরা কেউ বাড়িতে ছিলেন না। এলাকার মুসলিমরা এগিয়ে না এলে তাঁদের অনেক ক্ষতি হয়ে যেত। দীপালী রানি বর্মণ বলেন, ‘হামলার সময় ছেলেমেয়েকে নিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিই। ঘর কুপিয়ে গেছে। ঘটনার পর থেকে আমরা স্বস্তিতে নেই।’
বীর পশ্চিমপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুল হাই বলেন, ‘সেদিন ৪০ জনের মতো লোক আসে। তাদের আমরা ঠেকানোর চেষ্টা করি। যারা হামলা করতে এসেছিল, তারা এলাকার কেউ নন।’
ময়মনসিংহ উত্তর জেলা যুবদলের সদস্য ও স্থানীয় বাসিন্দা এমদাদুল হক বলেন, ঘটনার পরপরই এলাকায় যান। সেদিন হুজুগে একটি পক্ষ সেখানে গিয়েছিলেন। হিন্দু পরিবারগুলো এখন আর ভয়ে নেই। তাঁরা তাঁদের খোঁজ রাখছেন।
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-লুটপাট
সরকার পতনের দিন বিকেলে গৌরীপুরের ডৌহাখলা ইউনিয়নের কলপাতাড়া বাজারে উত্তম বিশ্বাসের ফার্মেসিতে ভাঙচুর করে ওষুধ লুটপাট করা হয়। হামলার পর থেকে তাঁর দোকানটি বন্ধ। উত্তম বিশ্বাস বলেন, ‘আমি কোনো রাজনীতি করি না। আমার দোকানে কেন হামলা হলো, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনো খুঁজছি।’
গুঁজিখা গ্রামে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোমনাথ সাহার কারখানায় হামলা করে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং তাঁর ভাই সুশান্ত সাহার রামগোপালপুর বাজারের পাশের গুদাম থেকে গ্যাসের সিলিন্ডার লুট করা হয়েছে। গৌরীপুর মধ্যবাজার পাল ব্রাদার্স এন্টারপ্রাইজে হামলা ও লুট, ভুলু পালের স্টেশনারি ও কসমেটিকসের দোকানে লুট, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি বিপ্লব মণ্ডলের দোকান কোপানো হয়েছে।
এ ছাড়া গৌরীপুর বাজারের লোকনাথ সুইটস অ্যান্ড বেকারি, স্টেশন রোডের নারায়ণ চন্দ্র পণ্ডিতের ফার্মেসি সার্টারে ও পাশের অনিল ঘোষের বাসার সামনে, বিপ্লব পালের ধানের গদিঘরের সার্টারে, কালিখলা এলাকায় গোবিন্দ মিষ্টান্ন ভান্ডারে এবং জেলখানা মোড়ে মিলন চৌহানের চা–দোকানে হামলা-লুটপাট হয়েছে। রামগোপালপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শিশির সরকারের গুদামঘরে ভাঙচুর, একই এলাকায় সঞ্জিত বিশ্বাসের মিষ্টির দোকানে লুটপাট, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি গৌরাঙ্গ বিশ্বাসের বাড়িতে হামলা করে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি বিপ্লব মণ্ডল বলেন, ৫ আগস্ট বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর ওপর হামলা হয়। পরিস্থিতি এখন মোটামুটি স্বাভাবিক। তবে আতঙ্ক আছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাকিল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্টের পর আর কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। তাঁরা ইতিমধ্যে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনার একটি খসড়া তালিকা করেছেন। আক্রান্তের স্থাপনার সংখ্যা ১৭ হলেও সেটি পূর্ণাঙ্গ করার কাজ চলছে। আক্রান্ত স্থাপনার মধ্যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বেশি। কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়নি। তিনি যেকোনো প্রয়োজনে জেলেপাড়ার লোকজনকে যোগাযোগ করতে বলেছেন। জেলেপাড়ায় তাঁরা সরেজমিনে যাবেন।