রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন সপ্তাহে ১৩১ শিক্ষার্থী জন্ডিসে আক্রান্ত
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হঠাৎ জন্ডিসের প্রকোপ বেড়েছে। গত তিন সপ্তাহে ৩২৪ জন শিক্ষার্থী জন্ডিস পরীক্ষা করেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্তত ১৩১ শিক্ষার্থীর জন্ডিস ধরা পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ও ক্যাম্পাসের দোকানগুলোতে সুপেয় পানির অভাব এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার পরিবেশনের কারণে এমনটা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকেরা।
এদিকে জন্ডিসের প্রকোপ বৃদ্ধি পেলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্যাম্পাসের দোকানগুলোতে এক দিন তদারকি ছাড়া কার্যত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার পরিবেশন নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ‘দোকানি ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতিমধ্যে এক দিন ক্যাম্পেইন করা হয়েছে। তা ছাড়া ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোতে যেন সাবমারসিবল পাম্পের পানি পরিবেশন করা হয়, সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছি। যদি কেউ সাপ্লাইয়ের পানি সরবরাহ করেন, সে ক্ষেত্রে তাঁকে জরিমানা করা হবে। পুরো ক্যাম্পাসে সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিতে চারটি সাবমারসিবল পাম্প বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ছাড়া ক্যাম্পাসজুড়ে জন্ডিস বিষয়ে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করা হবে।’
দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের খাবার ও পানি নিয়ে অভিযোগ করলেও প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পরিচিতদের অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রের তথ্য অনুয়ায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে হঠাৎ জন্ডিসে আক্রান্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১৫ জানুয়ারি থেকে জন্ডিসে আক্রান্ত শিক্ষার্থী ও অসুস্থ হয়ে জন্ডিস পরীক্ষা করা রোগীর সংখ্যা লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। গত ২১ দিনে (১৫ থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি) জন্ডিস পরীক্ষা করেছেন ৩২৪ শিক্ষার্থী। তাঁদের মধ্যে ১৩১ শিক্ষার্থীর জন্ডিস শনাক্ত হয়েছে। এ হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ৬ জন শিক্ষার্থী এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রের প্রধান চিকিৎসক তবিবুর রহমান শেখ বলেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে জন্ডিসের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। মূলত অস্বাস্থ্যকর পানি ও খাবারের কারণে জন্ডিস দেখা দেয়। হেপাটাইটিস এ ভাইরাসে আক্রান্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। অস্বাস্থ্যকর পানি ও খাবার খাওয়ার কারণেই শিক্ষার্থীরা এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
ক্যাম্পাসে সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিতে চারটি সাবমারসিবল পাম্প বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জন্ডিস বিষয়ে সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করা হবে।
ক্যাম্পাসে পানি ও অস্বাস্থ্যকর খাবার
সকালে ও দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের ভ্রাম্যমাণ দোকানের খাবার খান। ক্যাম্পাসের টুকিটাকি চত্বর, সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী ভবন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাডেমিক ভবন, ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া একাডেমিক ভবন, বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন দোকানগুলোতে অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানি সরবরাহ করা হয় বলে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ। সাপ্লাইয়ের পানি দ্বারা খাবার রান্নাও করা হয়। দোকানগুলোতে অপরিষ্কার পানির ট্যাঙ্কে খাওয়ার পানি রাখা হয় এবং খোলা অবস্থায় খাবার পরিবেশন করা হয়।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক
জন্ডিসের প্রকোপ বাড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১৫ জন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে জন্ডিস পরীক্ষা করছেন। সম্প্রতি জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছেন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী শামিম উদ্দিন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন কাজলা এলাকার একটি মেসে থাকেন। শামিম উদ্দিন বলেন, ‘ক্যাম্পাসে বেশি সময় থাকার কারণে বাইরেই খাওয়া হয়। খাবারের দোকানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পানি ও খাবার পরিবেশন করা হয়। চিকিৎসক জানিয়েছেন, এসব খাবার খেয়েই এ রোগে আক্রান্ত হয়েছি।’
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী কেয়া মনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের খাবার ও পানি নিয়ে অভিযোগ করলেও প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কয়েক সপ্তাহ ধরে হঠাৎ করে জন্ডিসের প্রকোপ বৃদ্ধি পেলেও কর্তৃপক্ষ নীরব। পরিচিতদের অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ বাড়ি চলে গেছেন। এই পরিস্থিতিতে খুবই আতঙ্ক কাজ করছে।
প্রশাসনের উদ্যোগ নেই
শিক্ষার্থীদের মধ্যে জন্ডিসের প্রকোপ বৃদ্ধি পেলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ক্যাম্পাসের ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোতে পানি ও খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়মিত তদারক করা হচ্ছে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য সুলতান-উল-ইসলাম দাবি করেন, এক সপ্তাহে আগে তিনি ক্যাম্পাসের দোকানগুলো তদারক করেছেন। পুরোনো পানির ট্যাঙ্কগুলো পরিবর্তন ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে খাবার পরিবেশন করতে বলেছেন। কেন শিক্ষার্থীরা এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, এ রোগের প্রতিকার ও করণীয় সম্পর্কে ইতিমধ্যে একটি সচেতনতামূলক লিফলেট তৈরি করা হয়েছে। আগামীকাল (আজ) থেকে ক্যাম্পাসে এটি প্রচার করা হবে। হলগুলোতেও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও পানি পরিবেশন করার জন্য হল প্রাধ্যক্ষদের বলা হয়েছে।