দাম ভালো পেলেও গরু বিক্রি করে লোকসান

পাবনার সাঁথিয়া উপজলার করমজা চতুরহাটে বিভিন্ন স্থান থেকে গরু বিক্রি করার জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার কৃষক–খামারিরা কোরবানির পশুর হাটে গরু বিক্রি করে খুশি হতে পারছেন না। গত বছরের তুলনায় এবার গরুর দাম কিছুটা বেশি। তবে গোখাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় গরু বিক্রি করে তাঁদের লোকসানই হচ্ছে। যেসব কৃষক ও খামারি দুই-এক সপ্তাহ আগে ব্যাপারীদের কাছে বাড়ি থেকেই গরু বিক্রি করে দিয়েছেন, তাঁরা কিছুটা ভালো দাম পেয়েছেন।

পাবনা জেলার সবচেয়ে বড় কোরবানির পশুর হাট বলে পরিচিত সাঁথিয়ার করমজা চতুরহাট। এই হাটে গতকাল প্রায় ১০ হাজার গরু বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন কৃষক, খামারি ও পাইকাররা। প্রতি মঙ্গলবার এই হাট বসে বলে কোরবানি উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার ছিল শেষ হাট। এ কারণে এই হাটে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। এ হাটে শুধু স্থানীয় ক্রেতারাই আসেননি, আশপাশের জেলা ও উপজেলাগুলো থেকেও প্রচুর ক্রেতা এসেছিলেন গরু কিনতে। তবে হাটে কৃষক ও খামারিরা যে দাম প্রত্যাশা করে গরু নিয়ে এসেছিলেন, সেই দাম তাঁরা পাননি।

বেড়া ও সাথিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দুই উপজেলায় খামারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার। এর মধ্যে সাঁথিয়া উপজেলায় দুই হাজার ও বেড়া উপজেলায় রয়েছে দেড় হাজার। তবে খামারিদের সংগঠন সূত্রে জানা যায়, নিবন্ধিত খামারের বাইরেও অনেকে একটি বা দুটি করে অসংখ্য গরু পালন করে থাকেন।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বেড়া উপজেলায় এবার কোরবানির উপযোগী গরুর সংখ্যা ৩৪ হাজার ৫১৫, মহিষ ৬২৩, ছাগল ৪৪ হাজার ৫৪২ এবং ভেড়া ৬ হাজার ৯৫৯। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এবার এ উপজেলায় কোরবানির উপযোগী গবাদিপশুর সংখ্যা ৮৬ হাজার ৬৩৯টি। এর মধ্যে উপজেলার চাহিদা মেটানোর পরও ৪১ হাজার ৯৯২টি পশু উদ্বৃত্ত থাকবে। অন্যদিকে সাঁথিয়া উপজেলায় ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে এবার পালন করা হয়েছে ১৪ হাজার ৬০৬টি গরু, ৪৬৪টি মহিষ, ৪২ হাজার ৭৬৪টি ছাগল ও ৮ হাজার ৮২টি ভেড়া। অর্থাৎ এ উপজেলায় এবার কোরবানির উপযোগী গবাদিপশুর সংখ্যা মোট ৬৫ হাজার ৯১৬টি। এর মধ্যে এ উপজেলায় ৩২ হাজার ৫০০ পশুর চাহিদা থাকায় উদ্বৃত্ত রয়েছে প্রায় ৩৩ হাজার ৫০০টি পশু।

খামারিদের সংগঠন ও গরু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২ উপজেলায় অন্তত ২৫ হাজার পরিবার গবাদিপশু পালনের সঙ্গে জড়িত। পরিবারগুলো অল্প দামে ছোট বাছুর অথবা ছাগল-ভেড়া কিনে এক থেকে দেড় বছর লালনপালন করার পর কোরবানির সামনে সেগুলো বিক্রি করে ভালো আয় করে। স্থানীয়সহ দেশের বিভিন্ন এলাকার গরু ব্যবসায়ীরা ঈদুল আজহার অন্তত এক মাস আগেই দুই উপজেলার বিভিন্ন বাড়ি ঘুরে কোরবানির গরু কিনে থাকেন। এভাবে ব্যবসায়ীরা গরু কিনে সেগুলোকে নিয়ে তোলেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন কোরবানির হাটে।

পাবনায় কোরবানির পশুর সবচেয়ে বড় হাট বলে পরিচিত সাঁথিয়া উপজলার করমজা চতুরহাট
ছবি: প্রথম আলো

বেড়া পৌর এলাকার দক্ষিণপাড়া মহল্লার খামারি আবদুল আউয়াল জানান, গোখাদ্যের দাম হিসাব করলে গত বছরের তুলনায় এবার প্রতিটি গরুর দাম শতকরা ৩০–৪০ ভাগ বৃদ্ধি পাওয়া উচিত। কিন্তু গত বছরের তুলনায় দাম বেড়েছে শতকরা ৫ থেকে ১০ ভাগ। এই দামে গরু বিক্রি করে খামারিদের লোকসান হচ্ছে। তিনি আরও জানান, সপ্তাহ দুয়েক আগে বাড়ি থেকে একটি ষাঁড় ব্যাপারীদের কাছে তিন লাখ টাকায় বিক্রি করেছিলেন। অথচ আজ প্রায় একই আকৃতির আরেকটি ষাঁড় কোরবানির পশুর হাটে তোলার পর এর সর্বোচ্চ দাম ওঠে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

এক বছরে গোখাদ্যের দাম ব্যাপক বাড়িছে। এক লাখ টাকা দামের একটি গরুর পেছনে এক বছরে গোখাদ্য বাবদ অন্তত ২৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হইছে। অথচ হাটে আনার পর দেখা যাচ্ছে গত বছরের মতো প্রায় একই দামই বলতেছে। এরম দামে গরু বেচলি লস হয়া যাবি।
শহীদুল ইসলাম, খামার মালিক, সাঁথিয়া, পাবনা

গতকাল করমজা চতুরহাটে গরু বিক্রির জন্য খামারের দুটি ষাঁড় এনেছিলেন সাঁথিয়ার সোনাতলা গ্রামের শহীদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গত এক বছরে গোখাদ্যের দাম ব্যাপক বাড়িছে। তাই গরু পালনে খরচও অনেক বাড়িছে। এক লাখ টাকা দামের একটি গরুর পেছনে এক বছরে গোখাদ্য বাবদ অন্তত ২৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ হইছে। অথচ হাটে আনার পর দেখা যাচ্ছে গত বছরের মতো প্রায় একই দামই বলতেছে। এরম দামে গরু বেচলি লস হয়া যাবি।’

বেড়া পৌর এলাকার বৃশালিখা মহল্লার মোমিনুল ইসলাম একাধারে খামারি ও গরু ব্যবসায়ী। তিনি জানান, এবার বেড়াসহ আশপাশের এলাকায় গতবারের চেয়ে গরু পালন হয়েছে বেশি। সেই সঙ্গে গোখাদ্যের চড়া দামের কারণে গরু পালনের খরচও অনেক বেড়েছে। অথচ ১১ জুন করমজা চতুরহাটের দৃশ্য ছিল খুবই হতাশাজনক। মাংস হিসাবে দাম ধরলে গত বছরের তুলনায় এবার কোরবানির গরুর দাম মণপ্রতি দুই হাজার টাকা বেড়েছে। কিন্তু যে হারে গোখাদ্যের দাম বেড়েছে, তাতে মাংসের এমন দাম বাড়ায় খামারিদের লাভ দূরের কথা, লোকসান হবে। তিনি জানান, এর আগের বছরগুলোতে তিনি ঢাকার কোরবানির পশুর হাটগুলোতে প্রায় ১০০টির মতো গরু পাঠিয়েছেন। কিন্তু এবার স্থানীয় হাট থেকে গরু কিনে ঢাকায় পাঠানোর সাহস পাচ্ছেন না। তাঁর মতো অন্যান্য ব্যাপারীরাও ঢাকায় পাঠানোর জন্য গরু কিনছেন খুব ভেবেচিন্তে।

মোমিনুল ইসলাম আরও বলেন, গত বছর কোরবানির গরুর প্রতি মণ মাংসের দাম গড়ে ২৮ হাজার টাকার মতো ছিল। এবার তা বেড়ে ৩০ হাজার টাকা হয়েছে। এবার দেড় লাখ দামের একটি একটি গরুতে গড়ে পাঁচ মণ মাংস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে বোঝা যায় এই দামের একটি গরুর দাম ১০ হাজার টাকার মতো বেড়েছে। অথচ এমন দামের একটি গরুর পেছনে এক বছরে গোখাদ্য বাবদ অন্তত ২৫ হাজার টাকা বেশি খরচ হয়েছে। সেই হিসাবে এবার গত বছরের তুলনায় লাখ দেড়েক টাকা দামের গরুতে ১৫ হাজার টাকার মতো কম দাম পাওয়া যাচ্ছে।

পাবনার সাঁথিয়া উপজলার করমজা চতুরহাটে ছাগল বিক্রি করতে নিয়ে আসা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

বেড়া উপজেলা ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও খামারি মাহফুজা খানম বলেন, ‘১১ জুন তিনটা ষাঁড় হাটে পাঠিয়েছিলাম। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি ৪ লাখ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করছি। অথচ এটির দাম কোনোমতেই পাঁচ লাখ টাকার নিচে হওয়া উচিত ছিল না। বাকি দুটি ষাঁড় সাত লাখ টাকায় বিক্রির প্রত্যাশা থাকলেও হাটে সেগুলোর দাম ওঠে মাত্র সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। আসলে এবার বেশির ভাগ খামারিরই গরু বিক্রি করে লোকসান হবে। গোখাদ্যের দাম গত বছরের মতো থাকলে এমন দামে খামারিদের হয়তো লোকসান হতো না।’

বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা যথাক্রমে মিজানুর রহমান ও জহুরুল ইসলাম বলেন, এমনিতে গরুর দাম গত বছরের চেয়ে কিছুটা ভালো আছে। কিন্তু গোখাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় খামারিরা সমস্যায় রয়েছেন।