‘আমার ভালো ছেলেটা মিছিলে গেল, কিন্তু নিজের পা একটা হারাইয়া আইল’
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার মধ্যপাড়া ভরমোহিনী গ্রামের বাড়ির চার দেয়ালে এখন বন্দিজীবন কাটছে মো. ইনামুল কাওছারের (৩২)। কয়েক দিন আগেও দিব্যি ঘুরে বেড়াতেন এখানে-সেখানে। হাসপাতাল থেকে পাওয়া ক্রাচ আর দানের হুইলচেয়ারই এখন তাঁর চলার ভরসা!
৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে পা হারিয়েছেন ইনামুল। এর আগ পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করতেন তিনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে সেদিন সলঙ্গা বাজার এলাকায় মিছিল করছিলেন ইনামুল। পুলিশের ধাওয়ায় মিছিলটি হঠাৎ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সেখান থেকে বের হয়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ান। সেই স্মৃতির কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ঠিক সেই সময় আচমকা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে পুলিশ। আর একটি গুলি এসে তাঁর ডান পায়ের হাঁটুতে লাগে। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি মাটিতে ঢলে পড়েন। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে জেলা সদরের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
ইনামুলের ভাষ্য, হাসপাতালটিতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে আত্মীয়স্বজনেরা তাঁকে নিয়ে যান বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও যথাযথ চিকিৎসা মেলেনি। আট দিন পর দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি একটু অনুকূলে এলে তাঁকে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) নিয়ে যান পরিবারের লোকজন। কিন্তু তত দিনে ক্ষতি যা হওয়ার, হয়ে গেছে। সেখানে চিকিৎসার একপর্যায়ে জানা যায়, তাঁর পায়ের ক্ষতস্থানে পচন ধরেছে। আরও ক্ষতির আশঙ্কায় তাঁর পায়ের হাঁটুর ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কেটে ফেলার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা, তা–ই করা হয়।
ইনামুল বলেন, ‘৪ আগস্ট গুলি লাগার আগপর্যন্ত আমাদের জীবন ছিল এক রকম। কিন্তু পুলিশের একটি গুলি সবকিছু পাল্টে দিয়েছে।’ নিজের এমন অবস্থার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমার বড় মেয়েটা বলে, “বাবা আর আমাকে কোলে নিতে পারে না, বাইরে নিয়ে যায় না।” ছোট মেয়ে তো কিছু বুঝতেই পারছে না।’
বছর দেড়েক আগে ইনামুলের বাবা মারা যান। মা-ও বেশির ভাগ সময় অসুস্থ থাকেন। চার বোনের বিয়ের পর মা, ছোট ভাই, স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিলেন ইনামুল। উল্লাপাড়ার সরকারি আকবর আলী কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।পড়াশোনা শেষ করে বাবার রেখে যাওয়া জমিতে চাষাবাদ, গরু পালন আর বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্যের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে এখন আর কিছুই করতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমার তো আর কিছু হবে না। এমএ পাস ছোট ভাইটার জন্য একটা কর্মসংস্থান হলে সংসারটা চলতে পারবে।’
আমার তো আর কিছু হবে না। এমএ পাস ছোট ভাইটার জন্য একটা কর্মসংস্থান হলে সংসারটা চলতে পারবে।আন্দোলনে আহত ইনামুল কাওছার
ইনামুলের ছোট ভাই নাজমুল ইসলাম স্নাতকোত্তর পাস করে বড় ভাইয়ের সংসারেই আছেন। সাংসারিক কাজকর্মের পাশাপাশি আপাতত চাকরি খুঁজছেন তিনি। আক্ষেপ নিয়ে নাজমুল বলেন, ‘এখন তো চারদিকে শুধু অন্ধকার। সরকারি-বেসরকারি যেকোনো একটি চাকরির সুযোগ পেলে অসুস্থ মা, পঙ্গু ভাইসহ সংসারটা টানতে পারতাম।’ ভাই ইনামুলের চিকিৎসার জন্য জমানো অর্থের পাশাপাশি ধারদেনা করে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এখন পরিস্থিতি এমন যে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ভাইয়ের (ইনামুল) জন্য প্রয়োজনীয় খাবার জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ছেলের এমন অবস্থা দেখে বেশ কষ্ট পান ইনামুলের মা মনোয়ারা বেগম। ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর যেন দুশ্চিন্তার শেষ নেই। তিনি বলেন, ‘আমার ভালো ছেলেটা মিছিলে গেল, কিন্তু নিজের পা একটা হারাইয়া আইল।’ বড় ছেলের সংসার ও সন্তানদের কথা বিবেচনা করে ছোট ছেলে নাজমুলের জন্য একটি চাকরির দাবি করেন তিনি।
বিষয়টি জানার পর আমি উপজেলা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ইনামুলদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ইনামুলসহ পরিবারের জন্য কিছু একটা সহায়তা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাহিদ হাসান খানে
ইনামুলের চাচা মো. আমজাদ হোসেন বলেন, পুলিশের গুলিতে মারাত্মক আহত হওয়ার পর ইনামুলের ঠিকমতো চিকিৎসা হয়নি। এখন ছোট দুটি সন্তান, স্ত্রী, অসুস্থ মা ও বেকার ভাইকে নিয়ে দিশাহারা অবস্থায় আছেন সবাই। তিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার অনুরোধ করেন।
বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাহিদ হাসান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর আমি উপজেলা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ইনামুলদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ইনামুলসহ পরিবারের জন্য কিছু একটা সহায়তা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’