সাত দিন পর গত রাতে মো. ফরাজি মিয়ার (৫৫) ঘর থেকে পানি নেমেছে। কিন্তু তাঁর উঠানে এখনো হাঁটুপানি রয়েছে। সড়ক তলিয়ে আছে। সেই পানি ঠেলে আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার আমতলী বাজারে আসছিলেন তিনি। মুখ শুকনা। কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
ঘরের খাবার ফুরিয়ে গেছে ফরাজি মিয়ার। ঘর পানিতে তলিয়ে থাকার সময় ত্রাণ পেয়েছিলেন কি না, জানতে চাইলে প্রথমে ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকান। কিছুক্ষণ পরেই ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘কুঠাই (কোথায়) ত্রাণ, দিলে পাবলিক (মানু) পাইলোনি-না? দুই-চারজন পাইলেও পাইতে পারে। সত্যি এটাই, ত্রাণই দেয় নাই। বন্যায় মানুষ ভাইসা (ভেসে) একবারের কূলকিনারা নাই। দেহেনছেন (দেখেন) নামা এলাকার মানুষের কী অবস্থা। সব টিউওবল (নলকূপ) তলাইয়া গেছে। মানুষ পচা পানিও খাইতাছে। কই ত্রাণ-তুন দেয় নাই। দেওয়ার কথাটা এমনি। কেউ চাল, টেহা (টাকা) বা অন্য কিছু কেউ পায় নাই।’
জামালপুরে তিন দিন ধরে বন্যার পানি কমলেও মানুষের দুর্ভোগ কমেনি। বিভিন্ন স্থানে লোকজন ঘরে ফেরা শুরু করলেও খাবার পাচ্ছেন না। ফলে ত্রাণের আশায় এখানে ওখানে ভিড় করছেন তাঁরা। পানিবন্দী বেশির ভাগ মানুষ চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। চারণভূমি এখনো ডুবে থাকায় গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে রয়েছেন বন্যার্তরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জামালপুর কার্যালয়ের কর্মকর্তা আবদুল মান্নান বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার পানি কমে আজ বেলা দেড়টার দিকে বিপৎসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কখনো নৌকা আবার কখনো হেঁটে ইসলামপুর উপজেলার দেওয়ানপাড়া, আমতলী, ডেবরাইপ্যাচ, দক্ষিণ চিনাডুলী, আজমবাদ, বলিয়াদহ ও পশ্চিম চিনাডুলী গ্রামে যান এই প্রতিবেদক। দেখা যায়, পানি কমতে থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট জেগে উঠতে শুরু করেছে। বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেওয়া লোকজন ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। বেশির ভাগ ঘর তলিয়ে যাওয়ায় ঘরের ভেতর বালুর চর পড়ে রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত ও ঘরের ভেতরে থাকা বালু ও কাদা সরাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন লোকজন। সড়কপথে সব যোগাযোগব্যবস্থা এখনো বন্ধ রয়েছে।
ডেবরাইপ্যাচ এলাকার আব্দুস সাত্তার ছোট্ট নাতিকে কাঁধে তুলে তীব্র স্নোতের মধ্যে আমতলী বাজার এলাকায় আসছিলেন। দুপুর ১২টার দিকে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘টানা সাত দিন বানের মধ্যে ছিলাম। ঘরে খাওন নাই। খুব অসুবিধা, মানুষ চলাফেরা করতে পারছে না। কেউ খোঁজখবর নিতেছে না। খাওনদাউন (খাওয়াদাওয়া) কঠিন অবস্থা। ঘরবাড়ি ছাইরা স্কুল-মাদ্রাসায় মানুষ থাকল। কই কেউ তো কিচ্ছু নিয়ে যায়নি। গরিব মানুষের কান্দন ছাড়া উপায় নাই। প্রতিটি বছর বানের মধ্যে কত কষ্ট করি। মাঠেঘাটে পানি আর পানি। কোথাও গরু-ছাগলের ঘাস নাই। কেমনে বাঁচে গরু-ছাগল।’
ডুবে থাকা চিনাডুলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে নৌকায় কথা হয় উপজেলা চিনাডুলী ইউনিয়নের ৮ নংম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. বাবু আনার সঙ্গে। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, আগে থেকেই এই অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা খারাপ। কারণ, প্রায় রাস্তা কাঁচা। সব সময় দুর্ভোগ লেগেই থাকে। এর মধ্যে বন্যায় সব মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। মানুষজন গত সাত দিনে হাটবাজারে যেতে পারেননি। কেউ শুকনা খাবারও সংগ্রহ করতে পারেননি। বন্যাদুর্গতদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, সবার করুণ অবস্থা। এই সাত দিনের মধ্যে কেউ কোনো সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য নিয়ে আসেনি। শুধু তাই-নয়, অসহায় মানুষগুলোকে কেউ দেখতেও আসেননি।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার বকশীগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ, মেলান্দহ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার ৪০টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার ২ লাখ ৫০ হাজার ২২৮ জন এই বন্যায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্লাবিত হয়েছে রাস্তাঘাট, হাটবাজার, ফসলি জমি, মৎস্যখামার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
বন্যার্তরা ত্রাণসামগ্রী না পাওয়াসহ নানা দুর্ভোগের অভিযোগ করে আসছে। এ বিষয়ে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, ‘বন্যা মোকাবিলায় আমরা তৎপর। সব সময় দুর্গত এলাকার খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।’