শ্বশুরের কাটা মাথা নিজের ব্যাগে বহন করছিলেন পুত্রবধূ
হত্যার পর শ্বশুরের কাটা মাথা নিজের ব্যাগে বহন করে নিয়ে যান পুত্রবধূ। পরে সেটি ফেলে দেন পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে। নিজের সংসার টিকিয়ে রাখতেই এমন কাজ করেছেন তিনি।
আজ মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদ্দাম হোসেনের আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে নিজের অপরাধের কথা স্বীকার করে এ কথা বলেন আনার কলি (২০) নামের এক নারী।
আনার কলি ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড থানার আকমল আলী সড়কের একটি বাড়িতে খুন হওয়া ব্যবসায়ী হাসান আলীর (৬১) পুত্রবধূ। আকমল আলী সড়কের ওই বাড়িটি আনার কলির স্বামী ও হাসান আলীর ছোট ছেলে শফিকুর রহমান (২৯) ভাড়া নিয়েছিলেন। ওই বাড়িতেই হাসান আলী দুই ছেলের হাতে খুন হন। সহযোগী হিসেবে ছিলেন তাঁর স্ত্রী ও এক পুত্রবধূ। হত্যার আলামত গায়েব করতে গিয়ে স্ত্রী ও সন্তানেরা ১০ টুকরো করেছিলেন হাসান আলীর দেহ। পরে নগরের তিনটি স্থানে ফেলে দিয়ে আসা হয় তাঁর দেহাংশ। হাসান আলীর মাথাটি নিজের ব্যাগে বহন করে নিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে ফেলে দিয়ে আসেন আনার কলি। হত্যাকাণ্ডের পর থেকে স্বামী শফিকুর রহমান পলাতক থাকলেও গত শুক্রবার আনার কলিকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। পরে তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়।
এর আগে তিন দিনের রিমান্ডে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পুত্রবধূ আনার কলিকে নিয়ে শফিকুর রহমানের মাথার খোঁজে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে তল্লাশি চালায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই। সেখানে আনার কলি সাংবাদিকদের বলেন, ‘তখন আমার আবেগ কাজ করেছে, বিবেক কাজ করেনি। বিবেক কাজ করলে এত বড় পাপে নিজে জড়িয়ে পড়তাম না।’
গত ২১ সেপ্টেম্বর রাতে নগরের পতেঙ্গা থানার ১২ নম্বর ঘাট এলাকায় খালের কাছ থেকে একটি লাগেজ উদ্ধার করে পুলিশ। এর ভেতরে মানুষের হাত ও পায়ের আটটি টুকরা পাওয়া যায়। উদ্ধার হওয়া আঙুলের ছাপের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত হয় হাসান আলীর।
এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে পতেঙ্গা থানায় একটি হত্যা মামলা করে। এরপর গত ২৩ সেপ্টেম্বর সকালে আকমল আলী রোডে ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ হাসান আলীর স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগম (৫০) ও বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানকে (৩২) গ্রেপ্তার করে। তাঁদের বাসার পাশের একটি ডোবা থেকে লাশের আরও দুটি অংশ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু মাথাটা পাওয়া যায়নি।
যে কারণে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড
নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব। দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকার পর বাড়ি ফিরে এসেছিলেন বাঁশখালীর বরইতলীর বাসিন্দা হাসান আলী। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক হাসান আলী ২৬ বছর আগে বাড়ি ছেড়ে সিলেটে চলে যান।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাড়িতে ফিরে আসার পর তাঁর বাবা হাসান আলী ভিটেবাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা চালান। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তাঁরা। এমন ক্ষোভ থেকেই বাবাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। হত্যার সময় মোস্তাফিজ নিজে ও তাঁর ছোট ভাই শফিকুর রহমান বাবার গলায় গামছা পেঁচিয়ে ধরেন। বাসায় তখন মা, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ছিলেন। সেদিন বাবার লাশটি বস্তায় ভরে বাসার খাটের নিচে রেখে দেন তাঁরা। পরে টুকরা করে বস্তা ও লাগেজে ভরে দূরে ফেলে দেন। লাগেজটি ফেলেন পতেঙ্গা ১২ নম্বর ঘাটে আর বস্তাটি বাসার পাশে একটি ডোবায় ফেলে দেন। তাঁর ছোট ছেলে শফিকুর ও তাঁর স্ত্রী আনার কলি মাথাটি পতেঙ্গা সৈকতে ফেলে দিয়ে আসেন।
আদালতে যা বললেন আনার কলি
হাসান আলীর পুত্রবধূ আনার কলি আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, তাঁর স্বামীর আকমল আলী রোডে ভাড়া বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন তাঁর শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাশুর মোস্তাফিজুর। সেখানেই ২০ সেপ্টেম্বর তাঁর শ্বশুর খুন হন। এরপর ২১ সেপ্টেম্বর আনার কলি তাঁর ব্যাগের ভেতর করে শ্বশুরের কাটা মাথাটি পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে নিয়ে যান। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্বামী শফিকুর। এরপর শফিকুর মাথাসহ ব্যাগটি সৈকতের পুলিশ বক্সের সামনের পাথরের বোল্ডারের ফাঁকে ফেলে দেন। এ ঘটনায় সবকিছু জেনেও চুপ ছিলেন তিনি। এটি তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে। সংসার ভেঙে যাবে, ভেবেই এমন অপরাধের সহযোগী হয়েছিলেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো পরিদর্শক ইলিয়াস খান প্রথম আলোকে বলেন, আনার কলি শ্বশুরের কাটা মাথাটি তাঁর ব্যাগে ভরে সমুদ্রসৈকতে ফেলে দেওয়ার কথা জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন। মাথার খোঁজে তাঁকে নিয়ে টানা দুই দিন তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু সৈকতে পাথরের ব্লকের ফাঁকে ব্যাগটি পাওয়া যায়নি। হয়তো জোয়ারের পানির সঙ্গে ভেসে গেছে।
নৃশংস এ ঘটনা বিচলিত করেছে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইলিয়াস খানকেও। আজ দুপুরে তিনি নিজের ফেসবুকে লেখেন, ‘মৃত হাসানের খণ্ডিত মাথার অংশটি দূর থেকে হয়তো আমাদের দেখছে, ডাকছে। কিন্তু দইজ্জার (সাগরের) সীমাহীন কূলে, সাগরের ঢেউ এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে হাসানের আর্তনাদ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না।’