পরিবেশকর্মীর সাক্ষাৎকার

পাখির মাংস বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকায়

সিলেটের পরিবেশ ও বন্য প্রাণী রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম চৌধুরী (কিম)। সম্প্রতি সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর এলাকার বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় দেশি ও পরিযায়ী পাখির মাংস বিক্রির ঘটনা বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে তাঁর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুমনকুমার দাশ

প্রথম আলো:

শীতের মৌসুমে সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাওরে পাখিশিকারিদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এসব থামাতে প্রশাসনের তৎপরতা খুব বেশি দেখা যায় না। আপনি কী মনে করেন?

আবদুল করিম চৌধুরী: পাখি শিকার বন্ধে বন বিভাগের অভিযান অনিয়মিত। তাদের লোকবলের সংকট এ জন্য অনেকাংশে দায়ী। তবে স্থানীয় প্রশাসন পাখিশিকারিদের দমনে বন বিভাগকে সহযোগিতা করতে পারলেও তাদের অনীহা ও আন্তরিকতার অভাব আছে। দেশে সংঘটিত বিভিন্ন প্রকার অপরাধের সঙ্গে তুলনা দিয়ে পাখি শিকারকে অনেকেই অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে অনাগ্রহী। ফলে শুধু শীত মৌসুম নয়, সিলেটে সব মৌসুমেই পাখি শিকার চলে। সাম্প্রতিক সময়ে হাওর অঞ্চলে বিষটোপের ব্যবহার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বিষটোপ ব্যবহারকারী শিকারিদের আটক করা কঠিন। তাঁরা মৃত পাখি বস্তাবন্দী করে ক্রেতার কাছে গোপনে পৌঁছে দেন।

প্রথম আলো:

দীর্ঘদিন ধরেই জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর এলাকার কয়েকটি রেস্তোরাঁয় রান্না করা পাখির মাংস বিক্রি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?

আবদুল করিম চৌধুরী: হরিপুরে দীর্ঘদিন ধরেই প্রকাশ্যে পাখির মাংস বিক্রি করা হয়। একজন পরিবেশকর্মী হিসেবে এ অপকর্ম বন্ধ করতে না পারা আমাদের জন্য হতাশার। হরিপুরে পাখির মাংস বিক্রির বিষয়টি আমাদের পীড়া দেয়। হরিপুরে পাখির মাংস বিক্রির ছবি ও ভিডিও সচেতন অনেক নাগরিক প্রতিকারের আশা নিয়ে আমাদের কাছে পাঠান। কিন্তু আমাদের পক্ষে তা বন্ধে কিছুই করা সম্ভব হয় না। এই অপরাধ বন্ধ করার দায়িত্ব মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের। আমরা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করি। কিন্তু মৌলভীবাজার থেকে সিলেটের হরিপুরে পাখির জন্য নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা কঠিন। তবে স্থানীয় প্রশাসন চাইলে এসব রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।

অনেক সময় এসব রেস্তোরাঁর সামনে পুলিশসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গাড়ি দেখা যায়। রেস্তোরাঁর মালিকেরা গর্বের সঙ্গে ক্রেতাদের বলেন, কোনো সমস্যা নেই। প্রশাসনসহ সবাই এখানে পাখি খেতে আসেন। মানুষের চাহিদার কারণে একের পর এক রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে এখানে।

প্রথম আলো:

যেসব রেস্তোরাঁয় পাখির মাংস রান্না করে বিক্রি হচ্ছে, সম্প্রতি সেসব রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এটা কী যথেষ্ট?

আবদুল করিম চৌধুরী: এটা যথেষ্ট নয়। এখানে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে। হরিপুরের রেস্তোরাঁমালিকেরা দিনের পর দিন অপরাধ করে যাচ্ছেন, অথচ মালিকদের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনের বলে কারাদণ্ড দেওয়ার নজির নেই। ফলে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেদারে শিকারিদের কাছ থেকে পাখি কিনছেন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা।

প্রথম আলো:

সিলেট নগরের বিভিন্ন স্থানেও দেশি-বিদেশি পাখি বিক্রি হতে দেখা যায়...

আবদুল করিম চৌধুরী: সিলেট নগরে প্রকাশ্যে পাখি বিক্রি একেবারেই কমে গেছে। হাতে গোনা কিছু বিক্রেতা সতর্কতার সঙ্গে নগরের দু-একটি স্থানে পাখি বিক্রির চেষ্টা শুরু করেছেন। তাঁদের ধরার জন্য নাগরিকদের সহযোগিতা প্রয়োজন। তবে প্রকাশ্যে বিক্রি কমে গেলেও টেলি মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে ক্রেতার কাছে পাখি পৌঁছানো হয়।

প্রথম আলো:

পাখি শিকার ও বিক্রি বন্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে? প্রশাসন কি যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছে?

আবদুল করিম চৌধুরী: পাখি শিকার বন্ধ করতে হলে আমাদের সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাড়াতে হবে। দেশি ও পরিযায়ী পাখি রক্ষা করা কেন প্রয়োজন, তা উপলব্ধিতে আনতে পারলে মাদক বিক্রির মতো পাখি বিক্রি কঠিন হয়ে যাবে। পাখি শিকারের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, ইউনিয়ন পর্যায়ে তাঁদের তালিকা করতে হবে। বিষটোপ দিয়ে হত্যা করা পাখি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকারক। এসব খাওয়া যে অনুচিত, সেটা মানুষকে বোঝাতে হবে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেশি ও পরিযায়ী পাখিদের ছবি ও জীবনচক্র নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করে শিশু মনে এসব পাখির জন্য মমত্ববোধ তৈরি করতে হবে।

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

আবদুল করিম চৌধুরী: প্রথম আলোর পাঠকদেরও ধন্যবাদ।