একাই সাতজনকে হত্যা করে ফেলবে আকাশ। তা-ও যাঁদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করে তাঁদের—বিষয়টি একেবারে ধারণার বাইরে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে। ওই গ্রামেই বেড়ে ওঠা চাঁদপুরের হাইমচরে মেঘনা নদীর ইশানবালা খালের মুখে এমভি আল-বাখেরা জাহাজে সাতজনকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফানের (২৬)। তিনি ওই গ্রামের জগদীশ মণ্ডলের ছেলে।
বুধবার বিকেলে গ্রামে গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মূলঘর গ্রামে মূলত আকাশের নানাবাড়ি। সেখানেই আকাশের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সেখানকার সরকারি শিশু পরিবারের পাশের খাসজমিতে থাকতেন আকাশের নানা সন্তোষ মণ্ডল। ওই সরকারি জমিতেই এখন থাকেন আকাশের আরেক ভাই বিধান মণ্ডল। বছর দেড়েক আগে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। বর্তমানে তাঁর নাম আবির হোসাইন।
প্রতিবেশীরা বলছেন, ছোটবেলা থেকেই অভাব-অনটনে দুই ভাই বড় হয়েছেন। অভাবের কারণে ছোটখাটো চুরির অভিযোগ ছিল আকাশের বিরুদ্ধে। তবে তিনি কাউকে হত্যা করতে পারেন, এটা তাঁদের ধারণার বাইরে। পরিবার ও স্থানীয় লোকজন বলছেন, দুই বছরের বেশি সময় ধরে এলাকার বাইরে আকাশ। আগে দুই ভাই একসঙ্গে থাকলে এক বছর ধরে তাঁদের মধ্যে তেমন কোনো যোগাযোগ নেই।
সন্ধ্যায় আবিরের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। এক বছর আগে তাঁর সঙ্গে বাগেরহাট সদর উপজেলার আঁখি বেগমের বিয়ে হয়। সেখানে টিনের বেড়া-চালের ছোট্ট ঘরে দেখা মেলে আঁখি বেগমের। তিনি বলেন, বিয়ের পর একবারই আকাশ বাড়িতে এসেছিল। তা-ও এক বছর আগে। এরপর আর কখনো আসেনি। তাঁদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগও ছিল না।
আবিরদের ঘরের উল্টো পাশে বাড়ি সৈয়দ জিহাদুল ইসলামের। তিনি বলেন, ‘প্রায় দুই বছর ধরে আকাশকে এলাকায় দেখি না। অভাব ও অভিভাবক না থাকায় এলাকায় মাছ-শাকের মতো ছোট চুরিতে জড়িত ছিল আকাশ। তবে সে এমন নৃশংস হতে পারে, তা মনে হয়নি। শান্ত স্বভাবের ছিল। মাছ ধরা, দিনমজুরি করত। বছর চারেক আগে ফকিরহাটের ফলতিতা বাজারে সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রির একটা ছোট দোকান দিয়েছিল দুই ভাই। তবে সেই দোকান বেশি দিন টেকেনি।’
মূলঘর গ্রামের মো. জুয়েল বলেন, নারীঘটিত একটা বিষয় নিয়ে দুই বছর আগে আকাশ এলাকা ছেড়ে চলে যান। এরপর আর তাঁকে দেখা যায়নি। শুনেছেন, মাঝে একবার নাকি এসেছিলেন। অনলাইনে দেখেছেন, জাহাজে নাকি আকাশ সাত খুন করেছে।
গ্রামের বাসিন্দাদের ভাষ্য, এলাকায় থাকতে বিড়ি-সিগারেট খাওয়া ছাড়া আকাশ মাদক সেবনে জড়িত এমন কখনো শোনেননি কেউ। সরকারি যে জমিতে তাঁর নানারা থাকতেন, সেখানেই তাঁদের জন্ম। ছোটবেলায় বাবা জগদীশ মণ্ডল মারা যাওয়ার পর মা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। পরে তাঁর অন্যত্র বিয়ে হয়। এরপর নানা-নানির কাছে দুই ভাই বড় হতে থাকেন। নানা-নানির মৃত্যুর পর তাঁরা সেখানে থাকতেন।
সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে ফেরেন আকাশের বড় ভাই আবির হোসাইন। তিনি বলেন, ‘এক বছর হলো তাঁর (আকাশ) সঙ্গে যোগাযোগ নেই। একটু মন–কষাকষি হয়েছিল আমার সাথে। তারপর আর কোনো যোগাযোগ নেই। এলাকা থেকে যাওয়ার পর জাহাজে কাজ নেয়। তারপর একবারই বাড়িতে এসেছে। তা-ও গত বছরের শীতের সময়।’ তিনি জানান, তাঁর বাবার বাড়ি পাশের মোল্লাহাট উপজেলার কোদালিয়া এলাকায়। ‘তবে সেখানে আমরা কখনো যাইনি। আমাদের জন্মমাটি এখানে।’
আকাশ বিয়ে করেছেন কি না, জানা নেই উল্লেখ করে আবির বলেন, ‘এলাকায় থাকতে তো বিয়ে করেনি। জাহাজে জাহাজে থাকত, এটাই জানতাম। আর আমাদের কারও সাথে কোনো কথা হতো না। টিভিতে দেখে লোকে বলছে, প্রথমে তো বিশ্বাস করিনি। পরে দেখি আকাশরেই দেখায়। সে যদি ওই ঘটনা ঘটায়, তবে তার শাস্তি হোক।’
বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার বাকেরগঞ্জ এলাকা থেকে আকাশকে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ঘটনার পর তিনি বাড়িতে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেননি বলে দাবি ভাইয়ের। এলাকায়ও কেউ তাঁদের এক বছরের মধ্যে দেখেননি বলে জানান।
র্যাবের ভাষ্য, জাহাজে সাত খুনের ঘটনায় আকাশ মণ্ডল ‘একমাত্র’ খুনি। নিয়মিত বেতন-ভাতা ও ছুটি না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি প্রথমে জাহাজের মাস্টারকে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে হত্যা করেন। জাহাজের অন্য ব্যক্তিরা জীবিত থাকলে সহজে ধরা পড়ে যাবেন ভেবে বাকি সবাইকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু তাঁদের মধ্যে একজন বেঁচে যান।