‘এমন নৃশংস ঘটনা আমার ছেলে ঘটাবে, চিন্তাও করতে পারি না’
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার উধুনিয়া ইউনিয়নের তেলিপাড়া গ্রাম। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার পশ্চিমে। এ গ্রামের রামকোমল ভৌমিকের বাড়িতে যখন পৌঁছাই, তখন বেলা প্রায় দুইটা। সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকেই চোখে পড়ল প্রমীলা রানী (৫৫) বারান্দার মেঝেতে বসে বিলাপ করছেন। এটি তাঁর ছোট বোন মিনা রানীর বাড়ি। রামকোমল মিনা রানীর স্বামী।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশে একই পরিবারের তিনজনকে গলা কেটে হত্যার কথা স্বীকার করা আসামি রাজীব কুমার ভৌমিক (৩৫) প্রমীলা রানীর ছেলে। হত্যার শিকার বিকাশ সরকার (৪৫) প্রমীলার আপন ছোট ভাই। গ্রেপ্তারের পর রাজীব পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানান, গত ২২ জানুয়ারি মামা বিকাশ তাঁর সঙ্গে যৌথ ব্যবসা থেকে প্রাপ্য টাকা সাত-আট দিনের মধ্যে ফেরত দেওয়ার জন্য তাঁকে চাপ দেন এবং টাকার জন্য তাঁর মাকে (প্রমীলা রানী) মুঠোফোনে কল করে গালমন্দ করেন। টাকা জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়ে ও বকাবকিতে মনঃকষ্ট পেয়ে মামা ও তাঁর পুরো পরিবারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন রাজীব।
প্রমীলা রানীর বাড়ি উল্লাপাড়ার তেলিপাড়া গ্রামেই। ছেলে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি নিজের বাড়িঘর ছেড়ে গত দুই দিন একই গ্রামেই বোন মিনা রানীর বাড়িতে থাকছেন। গত বুধবার রাতে তাড়াশ সদরের চালা মাগুড়া গ্রামের অনির্বাণ মহাশ্মশানে ভাই বিকাশ সরকার (৪৫), ভাইয়ের স্ত্রী স্বর্ণা রানী সরকার (৪০) ও তাঁদের একমাত্র মেয়ের পারমিতা সরকারের (১৫) শেষকৃত্যেও অংশ নিয়েছেন প্রমীলা রানী।
২০২১ সালে প্রমীলা রানীর স্বামী বিশ্বনাথ ভৌমিক মারা যান। তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। স্বামীকে হারিয়ে একমাত্র ছেলে রাজীবকে নিয়েই সংসার চলছিল তাঁর। সেই ছেলের হাতে ছোট ভাই পরিবারসহ খুন হলো, ছেলে এখন আইনের হাতে সোপর্দ। তিনি একা কী করে বেঁচে থাকবেন, বিলাপ করছিলেন আর সেই কথা বলছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সবার ছোট ভাই বিকাশ সরকার সবার দরকারে ছুটে আসত। রাজীবের বাবা মারা যাওয়ার পর ভাই আমার ছেলেকে ব্যবসা করতে টাকা দিয়েছিল। আর রাজীবের বাবার রেখে যাওয়া বিঘা সাতেক জমি আর পেনশনের টাকায় আমদের দিন কেটে যেত।’
রাজীবের মা জানান, ২০২০ সালের শুরুতে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) আশায় রাজীবের চাকরি হয়। প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার আগে আগে করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে সেটি আর হয়নি। পরে ছোট মামা বিকাশ সরকারের সঙ্গে যৌথ ব্যবসা শুরু করেন রাজীব। কিছুদিন আগে এ গ্রামে ৮-১০ বিঘার একটি জমিতে পুকুর খনন শুরু করেন রাজীব। কিন্তু নানা জটিলতায় এখানে বেশ কিছু টাকা আটকে যায়। এ ছাড়া ব্যবসাতেও কিছু লোকসান দেয়। ফলে মামা বিকাশ সরকারের সঙ্গে টাকা নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়।
প্রমীলা রানী বলেন, ‘ওর বাবার অসুস্থতার সময় অনেক টাকা খরচ হয়, কয়েক বছর আগে বাড়িতে নতুন করে ঘর করা হয়েছে। ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে। মেয়ে দেখাও চলছিল। অথচ কী কাজটা সে করে বসল? গ্রামের কারও সঙ্গে কোনো সমস্যা ছিল বলে শুনিনি। অথচ নিজের মামাসহ একটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল ছেলের হাতে।’
হত্যাকাণ্ডের আগে ভাই বিকাশ সরকার ফোন করে তাঁকে গালমন্দ করেছিলেন কি না—জানতে চাইলে প্রমীলা রানী বলেন, ‘কিছুদিন ধরে ব্যবসার টাকা নিয়ে রাজীব ও তার মামার মধ্যে ঝামেলা চলছিল। এ জন্য ভাই আমাকেও তাগাদা দিয়েছিল। তবে গালমন্দ করেনি। গালমন্দ করলে রাজীবকে করে থাকতে পারে। তবে এর জন্য এমন নৃশংস ঘটনা আমার ছেলে ঘটাবে, তা চিন্তাও করতে পারি না।’
নিহত বিকাশ সরকারের ভগ্নিপতি রামকোমল ভৌমিক (রাজীবের মেসো) বলেন, ‘ছেলেটা এমন কাজ কেমন করে করল বুঝতে পারছি না।’
রাজীবের পিসতুতো (ফুপাতো) ভাই তেলিপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যানিকেতনের সহকারী শিক্ষক রতন কুমার বলেন, রাজীব ওর বাবার স্কুল ফাজিলনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে। পরে প্রতাপ মহিউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় পাস করে। এরপর এইচএসসি পাস করে সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পাস করে।
রতন কুমারের স্ত্রী (রাজীবের বৌদি) শাপলা রানী প্রামাণিক বলেন, ‘আমার ভাশুরের মেয়ের বিয়ের জন্য গত রবি ও সোমবার রাজীব ও তার মা আমাদের বাড়িতে ছিল। কিন্তু তার মধ্যে কোনো অন্য রকম ভাব খেয়াল করিনি।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তেলিপাড়া গ্রামের দুজন বাসিন্দা বলেন, তাঁরা ছোট থেকে চেনেন রাজীবকে। কিন্তু কিছুদিন ধরে রাজীব খানিকটা বদলে যান। ব্যবসার পাশাপাশি মুঠোফোনে নানা ধরনের খেলার (অনলাইন জুয়া) সঙ্গে নাকি জড়িয়ে পড়েছিল বলে কানে এসেছিল তাঁদের।
প্রতাপ মহিউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের একজন ছাত্র এমন নৃশংস ঘটনার সঙ্গে জড়িত ভাবতে অবাক লাগে।’
গত সোমবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে তাড়াশ উপজেলা সদরের বারোয়ারি বটতলা মহল্লার একটি তিনতলা ভবনের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে বিকাশ সরকার, তাঁর স্ত্রী স্বর্ণা রানী সরকার এবং তাঁদের একমাত্র মেয়ে তাড়াশ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী পারমিতা সরকার ওরফে তুষির গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত বিকাশ সরকারের বড় ভাই প্রকাশ সরকার (৭০) তাড়াশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তিনতলা ভবনটিতে দুই ভাইয়ের পরিবার ও তাঁদের ভাড়াটেরা বসবাস করেন।