নবীনবরণে ছাত্রলীগ নেতাদের আমন্ত্রণ না জানানোয় ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে তিনজনকে আটক
মাদারীপুর সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ‘জিনিয়াস ক্লাব’ নামে একটি ছাত্রসংগঠন। অনুষ্ঠানে সংগঠনটির পক্ষ থেকে কলেজ শাখার ছাত্রলীগের কাউকে আমন্ত্রণ না জানানোয় ক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ নেতারা জিনিয়াস ক্লাবের তিন সদস্যকে ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে আটক করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরে আটক তিন কলেজছাত্রকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। আজ শনিবার দুপুর ১২টার দিকে মাদারীপুর সরকারি কলেজের মূল ভবনে এ ঘটনা ঘটে।
আটক তিন কলেজছাত্র হলেন মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার লক্ষ্মীপুর এলাকার নাসির উদ্দিনের ছেলে সাইফুল্লাহ মানসুর (২৩), গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার বাগিয়া এলাকার মনিরুজ্জামান মোল্লার ছেলে হামিম মোল্লা (২১) ও বরগুনার আমতলী উপজেলার আবদুল খলিফার ছেলে মাহফুজুর রহমান (২১)। তাঁদের মধ্যে সাইফুল্লাহ মাদারীপুর সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের, হামিম ও মাহাফুজুর পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের নিয়মিত শিক্ষার্থী।
আটক মাহফুজুর রহমান অভিযোগ করেন, ‘ছাত্রলীগ আমাদের শিবির নেতা বলে আখ্যায়িত করে পুলিশকে খবর দেয়। পরে পুলিশ আমাদের থানায় নিয়ে আসে। অথচ আমরা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নই। ছাত্রলীগের নেতারা তাদের আধিপত্য দেখানোর জন্য আমাদের সঙ্গে এই জঘন্য আচরণ করেছে।’
মাদারীপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ জামান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘একাদশ শ্রেণির নবীনবরণ অনুষ্ঠানের জন্য জিনিয়াস ক্লাবের সদস্যরা আমার কাছে মৌখিক অনুমতি নেয়। পরে আমি তাদের বলেছি, সবাইকে নিয়ে যদি অনুষ্ঠান করতে পারো, তাহলে করো। পরে শুনেছি ওই সংগঠনের তিনজনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আটক ছাত্ররা পুলিশের কাছে জবাবদিহি করবে। এখন আমরা কী করব? আমাদের কিছুই করার নেই।’
সাধারণ শিক্ষার্থী, কলেজ ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, জিনিয়াস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সাইফুল্লাহ মানসুর নবীনবরণ উৎসবের মূল আয়োজক। তাঁর নেতৃত্বে অন্য বিভাগের আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে কলেজের মূল ভবনের ৮ নম্বর কক্ষে আজ সকাল থেকেই চলতে থাকে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি। বেলা ১১টার দিকে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী ওই কক্ষে গিয়ে বাধা দেন। পরে সাইফুল্লাহসহ তিন কলেজছাত্রকে শিবিরের নেতা-কর্মী আখ্যা দিয়ে তাঁদের আটক করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। সেই সঙ্গে অনুষ্ঠানটি পণ্ড করে দেয় ছাত্রলীগ। সদর মডেল থানার পুলিশকে জানানো হলে পুলিশ কলেজে গিয়ে তিনজনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।
মাদারীপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনোয়ার হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অনুষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের কর্মীরা হট্টগোল করছেন—এমন খবর পেয়ে সেখানে পুলিশ যায়। পরে জিনিয়াস ক্লাবের সদস্যরা শিবির বলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা পুলিশের কাছে অভিযোগ দেন। এ কারণে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন কলেজছাত্রকে থানায় আনা হয়েছে। তাঁদের বিষয় তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থী সৈকত হোসেইন প্রথম আলোকে বলেন, অনুষ্ঠান শুরুর আগেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা কক্ষে ঢুকে সেটা পণ্ড করে দেন। এই আয়োজনে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছাড়াও অন্য শিক্ষার্থীরা এসেছিলেন। হট্টগোল দেখে তাঁরা সরে আসেন। পরে পুলিশ অনুষ্ঠানের ব্যানারসহ তিনজনকে ধরে নিয়ে যায়।
আটক তিন কলেজছাত্রের দাবি তাঁরা সাধারণ শিক্ষার্থী। তাঁরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। আটক সাইফুল্লাহ মানসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানের জন্য ফোন করে দাওয়াত দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানে আসার পরে আমরা জিনিয়াস ক্লাবের সদস্য সংগ্রহের কার্যক্রমও শুরু করি। অনুষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক সংগঠনকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। এ কারণে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আমাদের অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করেন।’
অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ‘কলেজে নবাগত শিক্ষার্থীদের নিয়ে নবীনবরণ অনুষ্ঠান করতে হলে অধ্যক্ষ, শিক্ষক সমিতি, ছাত্রসংগঠন সবাই জানবে। কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতিও থাকবে।
এসব কোনো কিছুই না করে একটি সন্ত্রাসী মহল কথিত একটি সংগঠন বানিয়ে তারা কলেজে হুট করে একটি নবীনবরণ উৎসবের আয়োজন করে। এ অনুষ্ঠানের আয়োজক দুজন শিবিরের সঙ্গে জড়িত বলে আমরা জেনেছি। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের অনুষ্ঠান বয়কট করে পুলিশকে জানালে পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়। এখানে আমরা তাদের কোনো বাধা বা মারধর কিছুই করিনি। তারা যে অভিযোগ করেছে, তা সত্য নয়।’
প্রত্যক্ষদর্শী সাব্বির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নবীনবরণের অনুষ্ঠান শুরু হবে এমন সময় ছাত্রলীগের কয়েক জন অনুপ্রবেশ করে “শিবির” বলে স্লোগান দিতে থাকে। এ সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওই রুম থেকে বের করে দেয়। সাধারণ ছাত্ররা ভালো কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেই সেখানে ছাত্রলীগ আধিপত্য দেখানোর চেষ্টা করে।’
পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শ্যামল চন্দ্র শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের বিভাগের দুই ছাত্রকে আটকের বিষয়টি তাঁরা জানেন না। এ বিষয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে দেখবেন।