সাতক্ষীরার তালা উপজেলা
বন্ধ করার পরও গোপনে হয়েছে ৭৪% বাল্যবিবাহ
এক বছরে তালা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর ৮৮টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছিল। এর মধ্যে ৬৫টি বিয়েই পরে হয়ে গেছে।
যে ৬৫টি বিয়ে হয়েছে, তার মধ্যে ছয়জনের বিবাহবিচ্ছেদও ঘটেছে।
সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রীরা বেশি বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে।
অভিভাবক ও জনপ্রতিনিধিদের সচেতনতার ওপর জোর দিয়েছেন অনেকে।
সাতক্ষীরার তালায় বাল্যবিবাহ বন্ধ করা যাচ্ছে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ বন্ধ করার পর আবার গোপনে বাড়িতে কিংবা অন্যত্র নিয়ে মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকেরা। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত তালা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় যেসব বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছিল, তার ৭৪ শতাংশই পরে বিয়ে হয়ে গেছে।
তালা উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ওই সময়ের মধ্যে উপজেলায় ৮৮টি বাল্যবিবাহ বন্ধ করা হয়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে উপজেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের কিশোর-কিশোরী ক্লাবের ২৭ জন সদস্য দিয়ে বন্ধ করা বাল্যবিবাহ সম্পর্কে একটি জরিপ চালানো হয়। জরিপের ফল বলছে, ২০২১ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের গত জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বন্ধ করা ৮৮টি বাল্যবিবাহের মধ্যে ৬৫টি বিয়ে হয়ে গেছে। এর মধ্যে আবার ছয়জনের বিবাহবিচ্ছেদও ঘটেছে।
বাল্যবিবাহ বন্ধ নিয়ে কাজ করে প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংগঠন। এর নির্বাহী পরিচালক শম্পা গোস্বামী প্রথম আলোকে, শুধু প্রশাসন কিংবা বেসরকারি সংস্থা দিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা কঠিন বিষয়। তিনি মনে করেন, সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রীরা বেশি বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। সবার আগে প্রতিদিন শ্রেণিকক্ষে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে ছাত্রীদের সচেতন করতে হবে।
১৮ বছরের আগে বাবা-মা কিংবা অভিভাবক বিয়ে দিতে চাইলে তারা আপত্তি করার পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনকে জানাবে। পাশাপাশি অভিভাবক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সচেতন করতে হবে। গোপনে কেউ বাল্যবিবাহ দিলে কিংবা আয়োজন করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে।
শুধু প্রশাসন কিংবা বেসরকারি সংস্থা দিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা কঠিন বিষয়। তিনি মনে করেন, সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির ছাত্রীরা বেশি বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। সবার আগে প্রতিদিন শ্রেণিকক্ষে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে ছাত্রীদের সচেতন করতে হবে।প্রেরণা নারী উন্নয়ন সংগঠন এর নির্বাহী পরিচালক শম্পা গোস্বামী
বাল্যবিবাহ বন্ধের পর বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েদের অভিভাবকেরা দাবি করেছেন, তাঁদের অমতে ও অজান্তে মেয়েরা প্রেম করে বিয়ে করেছে। কেউ কেউ বলছেন, তাঁরা দরিদ্র, সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে ভালো পাত্র পাওয়ায় মেয়েকে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়নের আক্তারুল ইসলাম নামের এক অভিভাবক জানান, গত বছরের নভেম্বরে তাঁরা মেয়ের বিয়ের আয়োজন করেন। কিন্তু মেয়ের বয়স ১৮ বছর না হওয়ায় উপজেলা মহিলা অধিদপ্তরের লোকজন এসে বিয়ে বন্ধ করে দেয়। ছেলেটি ভালো মনে করে বিয়ে বন্ধের দুই মাস পর মেয়েকে সেই ছেলের সঙ্গেই বিয়ে দেন। কিন্তু দুই মাস যেতে না–যেতেই যৌতুকের দাবিতে মেয়ের ওপর নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসে। একপর্যায়ে তাঁর মেয়েকে তালাক দেওয়া হয়। ওই অভিভাবক আরও জানান, তালাক হওয়ার পর তাঁর মেয়েকে তিনি স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছেন।
তবে উপজেলার সরুলিয়া ইউনিয়নের এক অভিভাবক তারক দাস বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি জানান, তাঁদের মেয়ের বয়স ১৮ বছর না হওয়ায় গত বছরের অক্টোবরে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর তাঁর মেয়ের বিয়ে বন্ধ করে দেয়। বিয়ে বন্ধের তিন মাস পর তাঁদের মেয়ে একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করে বাড়ি থেকে চলে যায়। বিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়ায় মেয়ে বাড়ি ফিরে আসে। পরে তিনি বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন।
মেয়ের ওপর দোষ চাপালেন একই ইউনিয়নের আরেক অভিভাবক। ওই নারী বলছেন, এক ছেলের সঙ্গে তাঁর মেয়ের প্রেম ছিল। গত বছরের অক্টোবরে তাঁরা মেয়েকে ওই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আয়োজন করেন। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের লোকজন এসে বিয়ে বন্ধ করে দেন এবং তাঁর কাছ থেকে মুচলেকা আদায় করেন। কিন্তু দুই মাসের মাথায় মেয়ে পালিয়ে গিয়ে ওই ছেলেকে বিয়ে করে।
ইউনিয়ন পর্যায়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি হচ্ছেন ওই ইউনিয়ন পরিষদেরই (ইউপি) চেয়ারম্যান। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সরুলিয়া ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল হাই গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, অভিভাবকেরা ইউএনওর কাছে মুচলেকা দিয়ে আসেন ঠিকই। পরে মেয়েকে নিয়ে জেলার বাইরে গিয়ে অথবা আত্মীয়ের বাড়িতে গোপনে বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের পর তাঁরা জানতে পারেন। তখন করার কিছু থাকে না।
তালা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুন নাহার জানান, বাল্যবিবাহ মুচলেকা কিংবা জরিমানা করে বন্ধ করা যাচ্ছে না। বন্ধ করার পর অভিভাবকরা গোপনে অন্য স্থানে নিয়ে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, জনসচেতনতা ছাড়া বাল্যবিবাহ নির্মূল করা সম্ভব নয়।
পাশাপাশি বাল্যবিবাহ বন্ধের পর যাতে ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে দিতে না পারে, এ জন্য তদারকিরও প্রয়োজন। অধিকাংশ ইউনিয়নে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে যে কমিটি রয়েছে, ওই কমিটিও গতিশীল নয়। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের লোকবল খুবই কম। যানবাহন নেই। বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য নেই কোনো বরাদ্দ। অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বাল্যবিবাহ বন্ধে সহযোগিতা করা তো দূরের কথা, তাঁরাও নানাভাবে বিয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে লক্ষণীয় একটা দিক হচ্ছে, বাল্যবিবাহ হচ্ছে এ খবর পেলে মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা বাল্যবিবাহটি বন্ধ করার উদ্যোগ নিচ্ছেন।
তাঁরা বাল্যবিবাহটি বন্ধও করছেন। কিন্তু তারপরের ঘটনা কী ঘটছে? তালা উপজেলার তথ্যই বলছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গোপনে বা যেকোনো উপায়ে বিয়েগুলো আবার হয়ে যাচ্ছে। এখানেই নজরদারির বিষয়টি জরুরি।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, যে কর্মকর্তারা বাল্যবিবাহ বন্ধ করলেন, তাঁরা অবশ্যই সাধুবাদ পাবেন। তবে ওই কর্মকর্তাদের প্রতি অনুরোধ, ঘটনাগুলো তাঁরা যাতে নজরদারির মধ্যে রাখেন।
রাশেদা কে চৌধূরীর মতে, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে স্থানীয় সরকার, বিশেষ করে স্থানীয় চেয়ারম্যানকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। বন্ধ করা বাল্যবিবাহের ঘটনা পুনরায় ঘটলে তার দায় নিতে হবে। আর স্থানীয় পর্যায়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কমিটিও আছে। কমিটিগুলোকে সক্রিয় করতে হবে।