কয়রার প্রাচীন নিদর্শন খালাস খাঁর দিঘি

খালাস খাঁর দিঘির দৃশ্য। শনিবার সকালে খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

খুলনার সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রা উপজেলাজুড়ে বহু বছর আগে গভীর বনাঞ্চল ছিল। কালের বিবর্তনে সেই বনাঞ্চল পরিষ্কার করে বসতি গড়ে উঠেছে। প্রাচীন অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে কয়রার গ্রামগুলোয়। তেমনই এক নিদর্শন উত্তর বেদকাশী এলাকার খালাস খাঁর দিঘি।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, পাঁচ শতাধিক বছরের প্রাচীন নিদর্শন এ দিঘি ইতিহাসের সাক্ষী। দিঘিটির অবস্থান কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের কলেজিয়েট স্কুলের সামনে।

লিখিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, সুলতানি আমলে হজরত খানজাহান আলী (রহ.)–র শিষ্য পীর খালাস খাঁ প্রথমে তাঁর সহযোগীদের নিয়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে সুন্দরবনের গভীরে প্রবেশ করেন। তিনি দলবল নিয়ে জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরি করতে করতে সামনের দিকে অগ্রসর হন। সবশেষে ১৪৩৭ থেকে ১৪৪২ সালের মধ্যে কয়রার বেদকাশীতে এসে আস্তানা গড়েন। ১৪৪৫ থেকে ১৪৫০ সালের মধ্যে বেদকাশীতে বিশাল একটি দিঘি খনন করেন। পরে তাঁর নামানুসারে দিঘিটি পরিচিতি পায় ‘খালাস খাঁর দিঘি’ নামে।

দিঘিটির দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৫০ ফুট ও প্রস্থ ৬০০ ফুট। দীঘির নামে ১২ দশমিক ৬৬ একর জমি সরকারি জরিপে রেকর্ড আছে। দিন দিন সংকুচিত হয়ে এখন এর আকার অনেকটাই কমে গেছে। প্রায়ই কাছের ও দূরের অনেক মানুষ এই দিঘি দেখতে আসেন। দিঘির এক পাড়ে পীর খালাস খাঁর আস্তানা ও মাজার। দিঘির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ইট দিয়ে গাঁথা একটি কালীর থান (মন্দির)। এসব স্থাপনা বর্তমানে ধ্বংসপ্রায়।
আজ শনিবার সকালে সরেজমিন দিঘিটির দক্ষিণ পাড়ে মানুষের বসতি দেখা গেছে। উত্তর ও পশ্চিম পাড়ের পাশ দিয়ে গেছে একটি পাকা রাস্তা। পাড়ে আছে নানা প্রজাতির গাছপালা। সেসব গাছে অনেক পাখি কিচিরমিচির করছে।

দিঘি সম্পর্কে জানতে চাইলে বেদকাশী এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান বলেন, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে খালাস খাঁর দিঘির আগের সেই সৌন্দর্য, মনোরম পরিবেশ, পরিযায়ী পাখিদের বিচরণ এখন আর নেই। ছোটবেলায় এ দিঘি নিয়ে অনেক রূপকথা শুনেছেন। কথিত আছে, এক রাতে পীর খালাস খাঁর অনুগত জিনরা খনন করে দিয়ে গেছে এ দিঘি। অতীতে এ দিঘির পানি হাটে হাটে বিক্রি করে অনেকে জীবিকা নির্বাহ পর্যন্ত করতেন। প্রচলিত বিশ্বাস ছিল, এর পানি পান করলে পেটের রোগ সারে। এখনো প্রায়ই এ দিঘি দেখতে আসেন অনেক মানুষ।

কয়রা কপোতাক্ষ মহাবিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আ ব ম আবদুল মালেক তাঁর লেখা ‘কয়রা উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, একসময় খালাস খাঁর দিঘির পানি ছিল খুবই মিষ্টি, রং ছিল লাল টকটকে। এর চার কোণায় নাকি চার রকম পানি পাওয়া যেত। এই অঞ্চলের মানুষের জীবনধারণের জন্য এ দীঘির পানিই ছিল একমাত্র ব্যবস্থা। বড় বড় হাটে এ দীঘির পানি বিক্রি হতো।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, ১৫ বছর আগেও ঐতিহাসিক দিঘিটি ছিল ঘন জঙ্গলে ঘেরা। দিঘির পাড়ে ছিল উঁচু টিলা। শত প্রজাতির গাছগাছালিতে অবাধ বিচরণ ছিল বিরল পাখপাখালির। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলা ও ২০২০ সালে আম্পানের আঘাতে নদীর লোনাপানিতে দিঘিটি তলিয়ে যাওয়ার পর থেকে এর সৌন্দর্য নষ্ট হয়।

কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, খালাস খাঁর দিঘি দেশের ইতিহাসের অংশ। এখন সরকারি ইজারা দিয়ে মাছ চাষের বাণিজ্যিক ব্যবহারে দিঘিটির রূপ পরিবর্তন তাঁদের ভাবিয়ে তুলছে। ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী দিঘিটি পরিকল্পিতভাবে সংরক্ষণ করা হলে এটিকে দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করা সম্ভব।