জীবিকার তাগিদে ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালানোর কাজ নেন কাজল মিয়া (২৫)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ঢাকায় রিকশা চালিয়েছেন তিনি। গত ১৮ জুলাই ঢাকার শনির আখড়া এলাকায় পুলিশের গুলিতে অনেক শিক্ষার্থীকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেন। তিনি দুজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে শোনেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে নিতে না পারায় তাঁরা মারা গেছেন। তিনি আর ঠিক থাকতে পারেননি। ১৯ জুলাই রিকশা রেখে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনিও গুলিবিদ্ধ হন।
গুলিবিদ্ধ কাজল মিয়া রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়ন পরিষদের দোহানী হাজিপুর গ্রামের মৃত আবদুল কাদেরের ছেলে। তাঁর কোনো জমিজমা নেই। স্ত্রী জিয়াসমিন ও শিশুসন্তান জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে বর্তমানে তিনি শ্বশুরবাড়িতে আছেন।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের অবদান স্মরণ করে গতকাল রোববার দুপুরে বদরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ হল রুমে সভা অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত স্মরণসভায় আন্দোলনের সময়ের কথা বর্ণনা করে কাজল মিয়া কান্নায় ভেঙে পড়েন।
স্মরণসভায় কাজল মিয়া বলেন, ‘ঢাকার শনির আখড়া এলাকায় আন্দোলন চলাকালে আমার সঙ্গে ছিলেন সাতজন। আমাদের লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি ছোড়ে। আমার চোখের সামনে গুলিতে চারজন মারা যায়, আমার বাঁ পায়ে গুলি লাগে। পায়ের অপারেশন হয়েছে তিনবার। হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত রড লাগানো আছে। লাঠিতে ভর করে চলাফেরা করতে হচ্ছে। পায়ের ভেতরে তীব্র যন্ত্রণা করে। আমি আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব না স্যার। দুই লাখ টাকা ঋণ হয়েছে নিজের চিকিৎসার পেছনে। সেই টাকা পরিশোধ করতে পারছি না। আয় বন্ধ। স্ত্রী ও ছয় বছরের সন্তান নিয়ে কষ্টে দিন চলছে। আমাকে একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেন।’
১৯ জুলাই থেকে ৫১ দিন ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। ৪ আগস্ট পর্যন্ত সেখানে কোনো চিকিৎসা পাইনি। ৫ আগস্টের পর থেকে আমার চিকিৎসা শুরু হয়।
কাজল মিয়া বলেন, ‘১৯ জুলাই থেকে ৫১ দিন ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। ৪ আগস্ট পর্যন্ত সেখানে কোনো চিকিৎসা পাইনি। ৫ আগস্টের পর থেকে আমার চিকিৎসা শুরু হয়। গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আসি। নিজের টাকায় চিকিৎসা করছি। প্রায় চার লাখ টাকা চিকিৎসার পেছনে খরচ করলেও এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা পাইনি। চিকিৎসা করতে গিয়ে দুই লাখ টাকা ঋণ হয়েছে। এই টাকা কীভাবে পরিশোধ করব, তা জানি না?’
আন্দোলনে আহত হয়েছেন শিক্ষার্থী সজীব মহন্ত। তিনি রংপুর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পড়ছেন। সভায় সজীব মহন্ত বলেন, ‘৪ আগস্ট বদরগঞ্জ পৌর শহরে মিছিল করার সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ছোড়া ইটপাটকেলের আঘাতে আমার মাথা ফেটে যায়। পরে মাথায় পাঁচটি সেলাই দেওয়া হয়। এখনো মাথায় যন্ত্রণা হয়।’
ঢাকা উত্তরা থানা এলাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন হাফেজ রেজওয়ান হোসাইন (২৩)। তিনি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের শিমুলতলী প্রামাণিকপাড়া গ্রামের সাইদুল ইসলামের ছেলে। স্মরণ সভায় সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘সপরিবার ঢাকায় ছিলাম। ৪ আগস্ট আমার ছেলে রেজওয়ান হোসাইন আন্দোলনে যেতে চাইলে বাধা দিই। তখন সে বলে, “বাবা আমাকে বাধা দিও না। জীবন দিয়ে হলেও এই স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে হবে। আমি মারা গেলেও তোমার আরও তিন সন্তান থাকবে।” এমন কথা বলে বাধা উপেক্ষা করে ছেলে আমার আন্দোলনে যায়। পরে খবর পাই, আওয়ামী লীগের দোসরেরা আমার ছেলেকে গুলি করে মেরেছে।’
সাইদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘সন্তান হারিয়ে পাওয়া দ্বিতীয় স্বাধীনতা ধরে রাখতে হবে, তাহলেই কেবল আমার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে।’ পুলিশের গুলিতে নিহত হাফেজ রেজওয়ান হোসাইনের স্ত্রী ও ৯ মাসের শিশুসন্তান আছে।
বদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জন মো. আবু মুসা, উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ, বদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ কে এম আতিকুর রহমান প্রমুখ। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বদরগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন ২০ জন আহত ও ১ জন নিহত হওয়ার তালিকা প্রকাশ করেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বদরগঞ্জ উপজেলার একজন সমন্বয়ক দাবি করে শিক্ষার্থী রেদওয়ান আহম্মেদ বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসন থেকে আহত ব্যক্তিদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তা দেখে হতবাক হয়েছি। যারা সাবেক এমপি ডিউক চৌধুরীর বাড়ি থেকে বের হয়ে আমাদের মিছিলে হামলা চালাল, তারাই আহতদের তালিকায় স্থান পেয়েছে। এ তালিকায় আন্দোলনে প্রকৃত আহত শিক্ষার্থীদের নাম নেই। তাই প্রশাসনকে পুনরায় তালিকা করতে বলেছি।’
এ বিষয়ে ইউএনও মিজানুর রহমান বলেন, হাসপাতালে ভর্তি রেজিস্টার দেখে চিকিৎসকেরা আহত ব্যক্তিদের নাম দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী তালিকা করা হয়েছে। কেউ বাদ পড়ে থাকলে জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করতে পারবেন।